দেবশ্রী মজুমদার: ‘আমি দুঃখিত যে আমার দেশ এক সময় সবথেকে সহনশীল ছিল। আজ তুলনামূলক কম সহনশীল। যদিও আমি বলব না, একেবারে অসহনশীল।’ নিজ প্রতীচী বাসভবন থেকে অমর্ত্য সেন তাঁর প্রিয় দেশ নিয়ে এমন চিন্তাভাবনা ব্যক্ত করেন। সময় পেলেই বিদেশ থেকে নিজ ভূমে ফিরে আসেন। এ দিন তিনি বলেন, ভারতের বিপদ সাম্প্রদায়িকতা, ক্যাপিটালিজম-এর প্রশ্রয়দাতা। আমি বরাবরই ক্যাপিটালিজমের কড়া সমালোচনা করেছি। ভারত এখন সেই দশার মধ্যে যাচ্ছে যেখানে ক্যাপিটালিজম কমিউন্যালিজমের হয়ে ওকালতি করছে। ক্যাপিটালিজমের সাহায্য ‘রেবরি’ বা প্রিভিরাজ কায়েম করে জনগণের কাছ থেকে পাওয়ার কিনে নিতে চাইছে। কিছু ক্ষেত্রে মানি ট্রান্সফার ঠিক আছে। তবে সেটি অর্গানাইজড ওয়েতে হওয়া উচিত। স্বাস্থ্য খাতে, রোগ মহামারি নিয়ন্ত্রণে, আবহাওয়া পরিবর্বতন রুখতে এই অর্থ ব্যয়ের মাধ্যমে গরিবদের বাঁচাতে হবে। মহাত্মা গান্ধি বলতেন, প্রকৃত অভাব শিক্ষার অভাব।
এ দিন তিনি বলেন, হিন্দুত্ববাদ আগেও ছিল। এখনও আছে। মাত্র দিনকয়েক আগে হরিয়ানায় ইউসুফ নামে এক সংখ্যালঘুকে গোরক্ষক বাহিনী পিটিয়ে মারে। সেই প্রসঙ্গে অমর্ত্য সেন বলেন, আমি খবরটি শুনেছি। খুবই বেদনাদায়ক। দেশে গণতন্ত্রের পক্ষে সবথেকে বড় বিপদ সাম্প্রদায়িকতা। একটি শক্তি গণতন্ত্রের নিয়মে ভারতে ক্ষমতাসীন। ইতালিতেও মুসোলিনি এভাবেই ক্ষমতায় আসে। এর মূলে সাম্প্রদায়িকতা, সংকীর্ণ মানসিকতা, সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদই দায়ী। কিন্তু আমার দেশে বিশেষ করে প্রাচীন ভারতে কখনও তা ছিল না। সম্রাট আকবরের পরধর্ম সহিষ্ণুতা আমরা সবাই জানি। আমরা বৌদ্ধধর্ম জানি। ভারতে সব ধর্মের মানুষ আশ্রয় পেয়েছেন, বেড়ে উঠেছেন। এই মিশ্র সংস্কূতিই শক্তিশালী ভারত গড়বে। এ ব্যাপারে আমি আশাহত নই। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে খুব একটা আশাবাদীও নই।
হিন্দুইজম আর বর্তমান হিন্দুত্ব এক নয়। গৌতম বুদ্ধের ডায়মন্ড সূত্র উল্লেখ করে অমর্ত্য সেন বলেন, অপর সম্প্রদায়কে পছন্দ করার বোধ থাকতে হবে। এই গ্রন্থ অনুবাদ করেন একজন ব্যক্তি যিনি অর্ধেক ভারতীয় এবং অর্ধেক তুর্কি।
তিনি বলেন, ভারত তার গৌরবদ্বীপ্ত অতীত ভুলতে বসেছে। আমার প্রথম ভাষা বাংলা। ইংরেজি তৃতীয় ভাষা। দ্বিতীয় ভাষা সংস্কূতি। সংস্কূতে লেখা এই সব পুস্তকের মধ্য দিয়ে আমি সেখানেই মাঝে মাঝে ফিরে যাই।
অমর্ত্য সেন বলেন, ভারতের গণতন্ত্রকে সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত করতে হলে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। কেন্দ্র সরকারের ওয়াকফ বিল পাস করা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এরা আইন করেই ছাড়বে। তবে যা হচ্ছে, তা ঠিক হচ্ছে না। একইভাবে ঋতম্ভরাকে দেশের জাতীয় সম্মাননা দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাবরি মসজিদ ভাঙা নিয়ে যিনি অভিযুক্ত তাকে পুরস্কার দেওয়া হল!
এর থেকে পরিত্রাণের উপায় বাতলাতে গিয়ে অমর্ত্য সেন বলেন, শিক্ষার অধিকার এবং ধর্ম পালনের অধিকার চাই। মতামত প্রকাশ বন্ধ করতে জেএনইউয়ের মতো প্রতিষ্ঠানে পার্টির লোক বসানো ঠিক নয়। প্রায় সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগে সম্প্রদায় দেখা হচ্ছে, কোয়ালিটি দেখা হচ্ছে না। একসময় আমি ঐতিহ্যবাহী নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ছিলাম। আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা হয় যে আমাকে প্রচুর স্যালারি দেওয়া হত। আরও অনেক কিছু। এগুলো সর্বৈব মিথ্যা।
এ দিন অমর্ত্য সেন তাঁর পূর্ব পুরুষের আদি নিবাস বাংলাদেশের ঢাকা প্রসঙ্গে বলেন, আগে সারাবাংলার রাজধানী ছিল ঢাকা। সেখান থেকে মুর্শিদকুলী খাঁ রাজধানী মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত করেন। অমর্ত্য সেন বলেন, ঢাকার নবাব পরিবারের সঙ্গে তাঁর পরিবারের সম্পর্ক ছিল। ছোটবেলায় আমি নবাবের বংশধরদের দেখেছি।