সাকিব সালিম: ‘দেশ, জাতি বা ধর্মের জন্য আপনি যা-ই করতে যান, আপনাকে বিরোধিতার মুখে পড়তে হবে। টিব্বি সম্মেলনও এই কাজের সঙ্গে যুক্ত। আপনারা হয়ত জানেন, তাবিব ও বৈদ্যরা পৃথক ভাবে কাজ করে থাকেন, তবে এই সম্মেলনের লক্ষ্য হল, তাঁরা যাতে যৌথ ভাবে কাজ করতে পারে সে জন্য তাঁদের সজাগ করা। সুতরাং, আপনাদের উভয়েরই উচিত এক সঙ্গে কাজ করা এবং লাগাতার কাজ করে যাওয়া। এই সম্মেলন আর কারও নয়, আপনাদেরই।’
১৯১১ সালে লখনৌতে হাকিম আজমল খান এই কথাগুলি বলেছিলেন। ইউনানি ও আয়ুর্বেদ চিকিৎসকদের ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করতে আহ্বান জানিয়েই তিনি এই মন্তব্য করেছিলেন। তাঁর এই বক্তব্যের পিছনে রয়েছে তৎকালীন বম্বে সরকারের প্রস্তাবিত একটি আইন। এই আইনে সমস্ত দেশীয় চিকিৎসা ব্যবস্থাগুলিকে নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়েছিল। কর্তৃপক্ষের মতে, এই শাস্ত্রগুলির বৈধতা ও কার্যকারিতা নেই।
জেড এ নিজামি উল্লেখ করেছেন, প্রস্তাবিত আইন মোতাবেক, কোনও হাকিম বা বৈদ্য স্বীকৃত চিকিৎসক হিসেবে নাম নথিভুক্ত করতে পারত না। শুধুমাত্র যাঁরা আগে ইউরোপ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন বা ভারতের স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উপাধি পেয়েছেন, তাঁরাই নাম নথিভুক্ত করতে পারবেন। ভারতীয় চিকিৎসা পদ্ধতিতে যাঁরা চিকিৎসা করতেন তাঁদের জন্য এই আইন ছিল মৃত্যু ঘন্টার মতো কেননা ইউনানি ও আয়ুর্বেদ চিকিৎসকদের অনুমোদন কেড়ে নেওয়ার পুরো দায়িত্বভার ও নিয়ন্ত্রণ তুলে দিয়েছিল মেডিকেল পরিষদের হাতে। এই আইনের বিরুদ্ধে জনমত জোগাড় করতে হাকিম আজমল খান স্বয়ং ময়দানে নামেন। এক দিকে, তিনি সারা দেশে ঘুরে ঘুরে এই আইনের সমস্যাগুলির কথা তুলে ধরেন, অন্য দিকে বিভিন্ন প্রদেশের সরকারগুলিও ভারতীয় চিকিৎসা ব্যবস্থাকে নিষিদ্ধ করে দিতে এই ধরনের আইন চালু করছে। হাকিম তাঁর আন্দোলন শুরু করেন ১৯১০ সালে দিল্লিতে প্রথম আয়ুর্বেদিক ও টিব্বি সম্মেলন আয়োজনের মাধ্যমে। এই সম্মেলনে গোটা দেশ থেকে ৩০০-র বেশি হাকিম ও বৈদ্য হাজির ছিলেন।
হাকিম আজমল খান দাবি করেন, প্রস্তাবিত মেডিকেল পরিষদে হাকিম ও বৈদ্যদের প্রতিনিধিত্বকে নিশ্চিত করতে হবে। তা ছাড়া, দিল্লির মাদ্রাসা টিব্বিয়া, বানওয়ারিলাল আয়ুর্বেদিক পাঠশালা দিল্লি, লখনৌয়ের তাকিমিল উল তিব ও পিলভিটের মাদ্রাসা তিব্বিয়া এবং জয়পুরের আয়ুর্বেদিক স্কুলকে মেডিকেল পরিষদের সদস্য হওয়ার জন্য যোগ্য বলে বিবেচনা করতে হবে। পাশাপাশি, কলকাতা, মাদ্রাস, এলাহাবাদ, লাহোর ও অন্যান্য সরকারি মেডিকেল কলেজ ও স্কুলের এমডি, এলএম অ্যান্ড এসের মতো উপাধিপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের মতো উক্ত প্রতিষ্ঠানগুলির হাকিম ও বৈদ্যদের জায়গা দিতে হবে।
১৯১৯ সালে তাঁর এই দাবিগুলি ফলপ্রসূ হয়। দেশীয় ওষুধগুলির কার্যকারিতা, এই ওষুধে ব্যবহৃত খনিজ, সবজি-জাতীয় ওষুধ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ ও পরীক্ষা করে দেখতে সরকার একটি তদন্ত কমিটি তৈরি করেছিল। উল্লেখ্য, ভারতীয় দেশজ চিকিৎসকদের এই ওষুধগুলি ব্রিটিশ ফার্মাকোপিয়ার অন্তর্ভুক্ত ছিল না। নিজামি যথার্থ ভাবে উল্লেখ করেছেন, হাকিম সাহেবের অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রচেষ্টার ফলে সরকার সম্মত হয় যে, হাকিম সাহেবের যথার্থ দাবিগুলিকে প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়া দরকার এবং দেশীয় চিকিৎসা ব্যবস্থাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ফলস্বরূপ, মাদ্রাস ও বিহারের সরকার টিব্বিয়া কলেজ খোলে এবং সংযুক্ত প্রদেশের (অধুনা উত্তরপ্রদেশ) সরকার বোর্ড অফ ইন্ডিয়ান মেডিসিন স্থাপন করে।
লখনউতে একটি টিব্বিয়া কলেজ ও হরিদ্বারে একটি আয়ুর্বেদিক কলেজ শুরু করতেও সম্মত হয় সরকার। সেই সঙ্গে মুসলিম ও হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়গুলি দ্বারা অনুমোদনপ্রাপ্ত ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক প্রতিষ্ঠানগুলিকেও আর্থিক সাহায্য দেওয়া হয়। জেলা ও পৌর বোর্ডগুলি স্থানীয় চিকিৎসা কেন্দ্রগুলিতে হাকিম ও বৈদ্যদের নিয়োগ করে। ১৯১৯ সালের মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কারে বলা হয়, চিকিৎসা রাষ্ট্রের নিজস্ব বিষয় এবং এটি নিয়ন্ত্রণ করবেন নির্বাচিত মন্ত্রীরা। দেশীয় চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে সরকারের বৈষম্য শেষ পর্যন্ত বন্ধ হল। এর পর থেকে, আয়ুর্বেদিক ও ইউনানি চিকিৎসা ব্যবস্থা সরকারের সাহায্য পেয়ে এসেছে। নিজামি বলেছেন, ‘এই ভাবে হাকিম সাহেব ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা ব্যবস্থাকে বাঁচিয়েছিলেন যা ছিল আমাদের জাতীয় ঐতিহ্যের অংশ। তিনি যদি সক্রিয় ভাবে উদ্যোগ না নিতেন তাহলে আমাদের আশঙ্কা সরকার ইউনানি ব্যবস্থাকে হয়ত চিরতরে অবলুপ্ত করে দিত।’