‘মাতৃভাষা বাংলা ভাষা/খোদার সেরা দান’।
এটা বোধহয় প্রত্যেক বাংলাভাষীরই মনের কথা। তাঁরা নিজ জবানকে নিজেদের সম্পদ বলে মনে করেন। তার মানে এই নয় যে, পৃথিবীর অপরাপর ভাষাগুলি বাংলাভাষীদের চোখে খানিকটা খাটো। প্রত্যেক জাতি-গোষ্ঠীরই নিজস্ব ভাষার প্রতি টান থাকার কথা।
কিন্তু এ কথাও সত্য, প্রবল ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও নানা কারণে বেশকিছু ভাষা পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আর আজকের দিনেও বিলুপ্ত হওয়ার বিপদের মধ্যে রয়েছে আরও কিছু ভাষা।
এটা যেমন একদিকে সত্য তেমনি সত্য হচ্ছে ভাষার আধিপত্যবাদ। এক ভাষার আধিপত্যে অন্য ভাষাকে দমিয়ে ফেলার চেষ্টা। উর্দুকে জবরদস্তি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করায় পাকিস্তান রাষ্ট্রটিই ভেঙে যায়। আর ভাষার অস্তিত্ব একটি জাতিসত্তার অস্তিত্ব হয়ে ওঠে। বিপন্ন অন্য ভাষাগুলিও বাংলাভাষার আন্দোলন থেকে অনুপ্রেরণা লাভ করে। শেষ পর্যন্ত কয়েকজন বাংলাদেশির চেষ্টায় রাষ্ট্রসংঘে ২১ ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করে।
এক সময় আরবি ছিল বিশ্বের মানুষের যোগাযোগ, গবেষণা, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ভাষা। পরে মুসলিমদের অবক্ষয়ের সুযোগে এই স্থানটি দখল করে ইংরেজি ভাষা। তবে অনেক দেশ কিন্তু নিজ দেশে আমাদের মতো ইংরেজি বা হিন্দিকে প্রয়োজনের বেশি প্রবেশাধিকার দেয়নি। তারা সেখানেই নিজ ভাষার দখল প্রতিষ্ঠিত রেখেছে। তাতে যে তারা খুব বেশি পিছিয়ে গেছে, তা কিন্তু নয়। জাপান, রাশিয়া, চিন এই পর্যায়ের দেশগুলির অন্যতম। তারা বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, গবেষণা, উচ্চশিক্ষা, সাহিত্য সবকিছুতেই নিজ ভাষাকে বহাল রেখেছে। তাতে অবশ্য এই রাষ্ট্রগুলি পিছিয়ে পড়েনি বা দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্নও হয়নি।
এবার আমাদের বাংলার কথা বলা যাক। বাংলা ভাষা পশ্চিমবঙ্গে দু’টি ভাষার আধিপত্যের মধ্যে ক্রমশ অবক্ষয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে বাংলা স্কুলগুলি খোদ রাজধানী কলকাতায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বাংলায় ইংরেজি ও হিন্দি সাইনবোর্ডের দাপাদাপি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরামর্শ সত্ত্বেও আমলারা ইংরেজিতেই যোগাযোগের জন্য চিঠিপত্র লিখতে পছন্দ করেন।
ভাষার মাহাত্ম্য তার চর্চার মধ্যে। প্রকৃতই যদি আমরা হাজার বছরেরও বেশি পুরনো আমাদের বাংলাভাষাকে ভালোবাসি, তাহলে দেখতে হবে প্রাত্যহিক জীবনচর্চা, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং প্রশাসনে আমরা বাংলাকে কতটুকু ব্যবহার করছি। এখন কিছু বাড়িতে ছেলেমেয়েদের ইংরেজিতেই বাবা-মায়ের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে উৎসাহ দেওয়া হয়। তাহলে আপন বাংলা ভাষাকে কি করে আমরা ‘আমরি বাংলা ভাষা, মোদের গরব মোদের আশা’ বলতে পারি! সেক্ষেত্রে এটা শুধু হারমোনিয়ামে বেসুরো, তবলার তাল ও রেওয়াজবিহীন আওয়াজ-উচ্চারণে সীমাবদ্ধ থেকে যাবে।