Notice: Function _load_textdomain_just_in_time was called incorrectly. Translation loading for the login-customizer domain was triggered too early. This is usually an indicator for some code in the plugin or theme running too early. Translations should be loaded at the init action or later. Please see Debugging in WordPress for more information. (This message was added in version 6.7.0.) in /home/u419551674/domains/puberkalom.in/public_html/wp-includes/functions.php on line 6121
ইসলামের দাওয়াত সবার জন্য | Puber Kalom
১৬ এপ্রিল ২০২৫, বুধবার, ২ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ইসলামের দাওয়াত সবার জন্য

ইমামা খাতুন
  • আপডেট : ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, সোমবার
  • / 72

ওসমান আলীঃ  সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে মানুষকে তৈরি করেছেন আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন। এছাড়াও দুনিয়ার সমস্ত জীব-জন্তু-পশু-পাখি-কীট-পতঙ্গও সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ্তায়ালা। এদেরকে সৃষ্টির নেপথ্য কারণগুলি হল, আল্লাহ্র ইবাদাত করা, পৃথিবী ও প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করা, জীবনচক্র ও প্রজনন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মনুষ্য প্রজাতীর হিতসাধন করা। কিন্তু মানুষকে নিছক আহার-মৈথুন ইত্যাদির নিমিত্তে আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব তৈরি করা হয়নি। অনেক দায়িত্ব-কর্তব্য সঁপে দিয়ে মানুষকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তিনি।

ধরাধামে মানুষের আবির্ভাব হয়েছে শুধুমাত্র বাহ্যিক কিছু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়েই নয়, সঙ্গে রয়েছে অদৃশ্য বিবেক, মনুষ্যত্ব এবং সর্বোপরি ষড়রিপু। কিন্তু আজকের ডটকম যুগে মানুষ তার আত্মজ মনুষ্যত্ব পরিত্যাগ করে পশুত্ব অর্জনের লক্ষ্যে অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছে। স্বভাবতই দেশ-কাল-সমাজ তথা সমগ্র বিশ্বে আজ মনুষ্যত্বের মন্বন্তর প্রকট আকার নিয়েছে। সজ্ঞানে ঠান্ডা মস্তিষ্কে শত অন্যায়-অত্যাচার-অবিচার করলেও বিবেকের দংশন আমাদেরকে সম্বিৎ ফিরতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। যেটা করতে ভালো লাগে সেটাই করে চলেছি। যেটা করা উচিত সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ নেই। পশ্চিমা দোষে দুষ্ট ও পশ্চিমা কালচারে পুষ্ট হয়ে চলনে-বলনে, কথায়-কাজে, আচার-আচরণে ঐশী সীমারেখা অবলীলায় বর্জন করেছি। আর অর্জন করেছি অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ও বেলেল্লাপনার শীর্ষস্থান।

মানুষের দায়িত্ব হল কিছু হক আদায় করা। যেমন আল্লাহ্র হক, বান্দাহর হক। আল্লাহর হকের মধ্যে অন্যতম হল মনুষ্য জাতীর জীবন বিধান হিসেবে পাঠানো শেষ ঐশীগ্রন্থ পবিত্র কুরআনের প্রতিটা কথা নির্দ্ধিধায় মেনে নেওয়া এবং নিজের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে তা যথাসম্ভব বাস্তবায়িত করা। পাশাপাশি আমরা যা জেনেছি-বুঝেছি, তা জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষকে জানানোর দায়িত্ব আমাদের। না হলে কাল কিয়ামতের ময়দানে প্রতিটা মুসলমানকে জবাবদিহি করতে হবে। মুসলিমদের কাছে পবিত্র কুরআন তথা সঠিক ইসলামকে পোঁছনোর কাজকে বলা হয় ইসলাহ্ বা সংশোধন। আর অমুসলিমদের কাছে ইসলামের বার্তা পৌঁছনোকে বলা হয় দাওয়াত।

 

মুসলিম সমাজের একটা বড় অংশ পবিত্র কুরআন-হাদিস মেনে ইসলাম পালন করেন না। বাপ-দাদা পূর্বপুরুষের আমল থেকে চলে আসা প্রথা-পরম্পরা বা রসম-রেওয়াজ দেখে এবং মেনে আমরা নিজেদেরকে মুসলিম বলে পরিচয় দিই। এক্ষেত্রে কিছু ভুল-ত্রুটি রয়ে যাওয়াটা অসঙ্গত নয়। কারণ মানুষ মাত্রেই ভুল হতে পারে। কিন্তু আমরা যদি সরাসরি কুরআন-হাদিসের শিক্ষা জীবনে প্রয়োগ করি, তাহলে ভুল হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। তাই মুসলিমদের মধ্যে ভুল-ত্রুটিগুলো দূর করতে সঠিক ইসলামকে পৌঁছে দেওয়ার কাজকে বলা হয় সংশোধন বা ইসলাহ।

 

আর অমুসলিম ভাইদেরকে তো ইসলামের ব্যাপারে আমরা যোজন যোজন দূরে রেখেছি। কোনও মুসলিম এর দায় অস্বীকার করতে পারেন না। মনে রাখতে হবে, কুরআন শুধুমাত্র মুসলিমদের জন্য নয়। কুরআনের ব্যাপ্তি বিশ্বজনীন। প্রায় ৭৫০ কোটি বিশ্বমানবতার চলার পথের পাথেয় যদি হয় পবিত্র কুরআন, তাহলে পৃথিবী থেকে দুর্ণীতি, বৈষম্য, বিদ্বেষ, পক্ষপাতিত্ব, হিংসা, হানাহানি, ভেদাভেদ ঘুচে যাবে।

 

এ পৃথিবী সকলের বাসযোগ্য হবে। মনুষ্য-রচিত মতবাদ কিংবা মতাদর্শে কোনও দেশ শান্তির ঠিকানা খুঁজে পায়নি। অসাম্য-বৈষম্য, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, পদের অপব্যবহার, স্বজন-পোষণ, হিংসা-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত নয় কোনও দেশ। আর এর মূল কারণ হল, মানুষের মধ্যে জবাবদিহির চেতনার অভাব। সকলে যদি ইসলামের এই কথাটি কায়মনোবাক্যে স্বীকার করে নেয় যে, প্রতিটা মানুষ রক্তের সম্পর্কের ভাই।

 

তাহলে শান্তি-সম্প্রীতি-সংহতির জন্য এত মূল্য দিতে হত না। প্রত্যেকে যদি বিশ্বাস করত, মানুষ মরণশীল। একদিন সকলকেই মৃত্যুর স্বাদ নিতে হবে। আর পরকালে গিয়ে ইহকালের প্রতিটা কাজের জন্য জবাব দিতে হবে, তাহলে মানুষ অন্যায় কথা বলা ও অন্যায় কাজ করা থেকে ১৮০ ডিগ্রি বিপরীতে অবস্থান করত। মুসলমান ভাই-বোনেরা আখেরাত বা শেষ বিচারে বিশ্বাস করলেও, ঈমান তত মজবুত নয়। তাই আমাদের মুসলিম সমাজ আজ বেইমানি, নাফরমানি, না-ইনসাফির আঁতুড়ঘরে পরিণত হয়েছে।

দাওয়াতের পদ্ধতি :

ধর্মমত নির্বিশেষে সকলের সঙ্গে একাত্মভাবে মেলামেশা করতে হবে। একেবারে পারিবারিক অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ও হৃদ্যতা গড়ে তুলতে হবে। অভিন্ন হৃদয় বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে হবে। তবেই সে আমাদের কথা শুনবে। মানুষ এখন খুব ফাস্ট লাইফ লিড করতে অভ্যস্ত। সকলেই ভীষণ ব্যস্ত। বসে বসে কথা শোনার মতো সময় কারও হাতে নেই। তাই পরস্পরের মধ্যে অকৃত্রিম মধুর সম্পর্ক থাকলে তবেই সে আপনার কথা শুনবে।

অমুসলিমদের ভাইবোনেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য-আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখতে হবে আমাদেরকে। তাদের চিরাচরিত ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত দিয়ে কথা বলা যাবে না। নিজেকে ওভার এস্টিমেট কিংবা অপরকে আন্ডার এস্টিমেট করা যাবে না। সবার মধ্যেই কিছু ভালো গুণ আছে। শুধু খারাপটা দেখলে চলবে না। দোষ-ত্রুটি খুঁজতে গেলে ঠক বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে। তাই দোষালোচনা নয়, তার গুণাবলীর প্রশংসা করতে হবে। তবেই সে মনোযোগ দিয়ে আপনার কথা শুনতে চাইবে। মনে রাখবেন একটা বন্ধ ঘড়িও দিনে অন্তত দু-বার ঠিক সময় দেয়।

নিজেকে প্রপার নলেজেবল হতে হবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে আপ-টু-ডেট রাখতে হবে। তাই বলে জ্ঞানের পাহাড় হতে বলছি না। যেটুকু জ্ঞান অর্জন করেছি, বাস্তবে সেটাকেই সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হবে। নলেজ ইজ পাওয়ার, কিন্তু প্রপার ইমপ্লিমেন্টেশন অব নলেজ ইজ হর্স পাওয়ার।

ধৈর্য্য সহকারে তাঁর যাবতীয় বক্তব্য শুনতে হবে। তাঁর কথা শেষ হলে তবেই আপনি শুরু করবেন। মনে রাখতে হবে, কোনও মানুষ একটানা বেশি কথা বলতে পারে না। শ্রোতা চুপচাপ থাকলে বক্তার বাকশক্তি আপনা হতেই হ্রাস পায়। তার কথার মাঝে পাল্টা কথা বলা উচিত নয়।

আলোচনায় উত্তম কৌশল ও মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে হবে। আল্লাহ্তায়ালা পবিত্র কুরআনে বারংবার এই তাগিদ দিয়েছেন। খেয়াল রাখতে হবে সে যেন উত্তেজিত হয়ে না পড়ে। তাহলে মাঝপথে আলোচনার ছন্দপতন ঘটে যাবে। যার পরিণতি অদূর ভবিষ্যতে মারাত্মক আকার নিতে পারে।

আমরা বলব কম, শুনব বেশি। কারণ আল্লাহ্তায়ালা আমাদেরকে দুটি কান দিয়েছেন, কিন্তু মুখ দিয়েছেন একটি। প্রচণ্ড পড়াশোনা করতে হবে। পড়লে জানতে পারব যে, আমরা কত কী জানি না। আমি যা যা জানি, তা তো আমার জানাই রয়েছে। কিন্তু আমি যে কত কিছু জানি না, তা কি আমার জানা আছে? তাই পড়তে হবে। পড়ার কোনও বিকল্প নেই। মনে রাখতে হবে, রিডার ইজ লিডার।

 

বই মনের সই, বই জ্ঞানের মই। কুরআন শরীফে আল্লাহ্তায়ালার পক্ষ থেকে প্রথম যে শধটা নাযিল হয়েছিল, তা হল ‘ইকরা’, অর্থাৎ পড়ো। পড়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে গড়া যায়। এডুকেশন ইজ ফার্স্ট, এডুকেশন ইজ মাস্ট এবং এডুকেশন ইজ লাস্ট। পড়াশোনাই হল প্রকৃত মুসলমানের জিয়নকাঠি। শিক্ষার কোনও শেষ নেই। দোলনা থেকে খাটিয়া পর্যন্ত শিখতে হবে। তার থেকেও বড় কথা হল শেখার মানসিকতা রাখতে হবে। শুধুমাত্র শিক্ষা দিয়েই হয়ত সবসময় লক্ষ্য পূরণ হবে না। কিন্তু লক্ষ্য পূরণের জন্য শিক্ষা অর্জন জরুরি।

মানুষকে চিনতে হবে, জানতে হবে, বুঝতে হবে এবং বোঝাতে হবে। তাই আগে নিজেকে ভালোভাবে বুঝতে হবে। নিজে না বুঝলে অপরকে বোঝানো সম্ভব নয়। একটা মানুষের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ রিড করার দক্ষতা অর্জন করতে হবে। সেই মতো আপনার বক্তব্যের ডেলিভারি হবে।

নিজের রোজকার জীবনে চলা-বলা, ওঠা-বসা, আচার-আচরণের মধ্যে সততা, নৈতিকতা, মানবিকতার স্ফূরণ ও বিকাশ ঘটাতে হবে। আর এ সবের মধ্য দিয়েই আপনার সামনে বসা মানুষটির আস্থাভাজন হতে হবে। শুধুমাত্র তাঁকে একবার পবিত্র কুরআন কিংবা হাদিসের কিছু ভালো ভালো কথা শুনিয়ে দিলেই কাজ খতম হবে না। রীতিমতো ফলো-আপ এবং ফলো-থ্রু চালিয়ে যেতে হবে সারা জীবন ধরে। দাওয়াত একটা অনগোয়িং প্রসেস। দেখা মাত্র সৌজন্য ও কুশল বিনিময় করতে হবে। ইসলামের দাওয়াত অমুসলিমদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আলাদা করে খুব বেশি সময় ইনভেস্ট করার প্রয়োজন নেই। আমাদের দৈনন্দিন কাজের ফাঁকেই এটা চলতে থাকবে। কর্মস্থলে সহকর্মীদের কাছে এবং প্রতিবেশিদের কাছে ইসলামের বার্তা পৌঁছতে হবে। অপরিচিত লোকদের কাছেও একই কাজ করতে হবে। কারণ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে এই কাজের জন্য আল্লাহ্তায়ালা আমাদেরকেই বেছে নিয়েছেন। অন্য কোনও প্রাণীর এই দায় নেই।

সর্বোপরি, আমাদের কাছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ জীবন-দর্শন রয়েছে। তাহলে আমরা আমাদের পরিচিতদের কাছে সেই বার্তা পৌঁছে দেব না কেন? আমার কাজ তো শুধু বলা। ফলাফল আল্লাহ্তায়ালা দেবেন। সে নিয়ে আমাদেরকে ভাবতে হবে না। হেদায়াত করার মালিক তো আসমান-জমিনের একচ্ছত্র অধিপতি আল্লাহ্। তিনি যেন আমাদেরকে দ্বীনের দায়ী হওয়ার তাওফিক দেন, আমীন!

 

Copyright © Puber Kalom All rights reserved.| Developed by eTech Builder

ইসলামের দাওয়াত সবার জন্য

আপডেট : ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, সোমবার

ওসমান আলীঃ  সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে মানুষকে তৈরি করেছেন আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন। এছাড়াও দুনিয়ার সমস্ত জীব-জন্তু-পশু-পাখি-কীট-পতঙ্গও সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ্তায়ালা। এদেরকে সৃষ্টির নেপথ্য কারণগুলি হল, আল্লাহ্র ইবাদাত করা, পৃথিবী ও প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করা, জীবনচক্র ও প্রজনন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মনুষ্য প্রজাতীর হিতসাধন করা। কিন্তু মানুষকে নিছক আহার-মৈথুন ইত্যাদির নিমিত্তে আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব তৈরি করা হয়নি। অনেক দায়িত্ব-কর্তব্য সঁপে দিয়ে মানুষকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তিনি।

ধরাধামে মানুষের আবির্ভাব হয়েছে শুধুমাত্র বাহ্যিক কিছু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়েই নয়, সঙ্গে রয়েছে অদৃশ্য বিবেক, মনুষ্যত্ব এবং সর্বোপরি ষড়রিপু। কিন্তু আজকের ডটকম যুগে মানুষ তার আত্মজ মনুষ্যত্ব পরিত্যাগ করে পশুত্ব অর্জনের লক্ষ্যে অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছে। স্বভাবতই দেশ-কাল-সমাজ তথা সমগ্র বিশ্বে আজ মনুষ্যত্বের মন্বন্তর প্রকট আকার নিয়েছে। সজ্ঞানে ঠান্ডা মস্তিষ্কে শত অন্যায়-অত্যাচার-অবিচার করলেও বিবেকের দংশন আমাদেরকে সম্বিৎ ফিরতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। যেটা করতে ভালো লাগে সেটাই করে চলেছি। যেটা করা উচিত সেদিকে বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ নেই। পশ্চিমা দোষে দুষ্ট ও পশ্চিমা কালচারে পুষ্ট হয়ে চলনে-বলনে, কথায়-কাজে, আচার-আচরণে ঐশী সীমারেখা অবলীলায় বর্জন করেছি। আর অর্জন করেছি অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ও বেলেল্লাপনার শীর্ষস্থান।

মানুষের দায়িত্ব হল কিছু হক আদায় করা। যেমন আল্লাহ্র হক, বান্দাহর হক। আল্লাহর হকের মধ্যে অন্যতম হল মনুষ্য জাতীর জীবন বিধান হিসেবে পাঠানো শেষ ঐশীগ্রন্থ পবিত্র কুরআনের প্রতিটা কথা নির্দ্ধিধায় মেনে নেওয়া এবং নিজের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে তা যথাসম্ভব বাস্তবায়িত করা। পাশাপাশি আমরা যা জেনেছি-বুঝেছি, তা জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষকে জানানোর দায়িত্ব আমাদের। না হলে কাল কিয়ামতের ময়দানে প্রতিটা মুসলমানকে জবাবদিহি করতে হবে। মুসলিমদের কাছে পবিত্র কুরআন তথা সঠিক ইসলামকে পোঁছনোর কাজকে বলা হয় ইসলাহ্ বা সংশোধন। আর অমুসলিমদের কাছে ইসলামের বার্তা পৌঁছনোকে বলা হয় দাওয়াত।

 

মুসলিম সমাজের একটা বড় অংশ পবিত্র কুরআন-হাদিস মেনে ইসলাম পালন করেন না। বাপ-দাদা পূর্বপুরুষের আমল থেকে চলে আসা প্রথা-পরম্পরা বা রসম-রেওয়াজ দেখে এবং মেনে আমরা নিজেদেরকে মুসলিম বলে পরিচয় দিই। এক্ষেত্রে কিছু ভুল-ত্রুটি রয়ে যাওয়াটা অসঙ্গত নয়। কারণ মানুষ মাত্রেই ভুল হতে পারে। কিন্তু আমরা যদি সরাসরি কুরআন-হাদিসের শিক্ষা জীবনে প্রয়োগ করি, তাহলে ভুল হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। তাই মুসলিমদের মধ্যে ভুল-ত্রুটিগুলো দূর করতে সঠিক ইসলামকে পৌঁছে দেওয়ার কাজকে বলা হয় সংশোধন বা ইসলাহ।

 

আর অমুসলিম ভাইদেরকে তো ইসলামের ব্যাপারে আমরা যোজন যোজন দূরে রেখেছি। কোনও মুসলিম এর দায় অস্বীকার করতে পারেন না। মনে রাখতে হবে, কুরআন শুধুমাত্র মুসলিমদের জন্য নয়। কুরআনের ব্যাপ্তি বিশ্বজনীন। প্রায় ৭৫০ কোটি বিশ্বমানবতার চলার পথের পাথেয় যদি হয় পবিত্র কুরআন, তাহলে পৃথিবী থেকে দুর্ণীতি, বৈষম্য, বিদ্বেষ, পক্ষপাতিত্ব, হিংসা, হানাহানি, ভেদাভেদ ঘুচে যাবে।

 

এ পৃথিবী সকলের বাসযোগ্য হবে। মনুষ্য-রচিত মতবাদ কিংবা মতাদর্শে কোনও দেশ শান্তির ঠিকানা খুঁজে পায়নি। অসাম্য-বৈষম্য, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, পদের অপব্যবহার, স্বজন-পোষণ, হিংসা-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত নয় কোনও দেশ। আর এর মূল কারণ হল, মানুষের মধ্যে জবাবদিহির চেতনার অভাব। সকলে যদি ইসলামের এই কথাটি কায়মনোবাক্যে স্বীকার করে নেয় যে, প্রতিটা মানুষ রক্তের সম্পর্কের ভাই।

 

তাহলে শান্তি-সম্প্রীতি-সংহতির জন্য এত মূল্য দিতে হত না। প্রত্যেকে যদি বিশ্বাস করত, মানুষ মরণশীল। একদিন সকলকেই মৃত্যুর স্বাদ নিতে হবে। আর পরকালে গিয়ে ইহকালের প্রতিটা কাজের জন্য জবাব দিতে হবে, তাহলে মানুষ অন্যায় কথা বলা ও অন্যায় কাজ করা থেকে ১৮০ ডিগ্রি বিপরীতে অবস্থান করত। মুসলমান ভাই-বোনেরা আখেরাত বা শেষ বিচারে বিশ্বাস করলেও, ঈমান তত মজবুত নয়। তাই আমাদের মুসলিম সমাজ আজ বেইমানি, নাফরমানি, না-ইনসাফির আঁতুড়ঘরে পরিণত হয়েছে।

দাওয়াতের পদ্ধতি :

ধর্মমত নির্বিশেষে সকলের সঙ্গে একাত্মভাবে মেলামেশা করতে হবে। একেবারে পারিবারিক অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ও হৃদ্যতা গড়ে তুলতে হবে। অভিন্ন হৃদয় বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে হবে। তবেই সে আমাদের কথা শুনবে। মানুষ এখন খুব ফাস্ট লাইফ লিড করতে অভ্যস্ত। সকলেই ভীষণ ব্যস্ত। বসে বসে কথা শোনার মতো সময় কারও হাতে নেই। তাই পরস্পরের মধ্যে অকৃত্রিম মধুর সম্পর্ক থাকলে তবেই সে আপনার কথা শুনবে।

অমুসলিমদের ভাইবোনেদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য-আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখতে হবে আমাদেরকে। তাদের চিরাচরিত ধর্ম বিশ্বাসে আঘাত দিয়ে কথা বলা যাবে না। নিজেকে ওভার এস্টিমেট কিংবা অপরকে আন্ডার এস্টিমেট করা যাবে না। সবার মধ্যেই কিছু ভালো গুণ আছে। শুধু খারাপটা দেখলে চলবে না। দোষ-ত্রুটি খুঁজতে গেলে ঠক বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে। তাই দোষালোচনা নয়, তার গুণাবলীর প্রশংসা করতে হবে। তবেই সে মনোযোগ দিয়ে আপনার কথা শুনতে চাইবে। মনে রাখবেন একটা বন্ধ ঘড়িও দিনে অন্তত দু-বার ঠিক সময় দেয়।

নিজেকে প্রপার নলেজেবল হতে হবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে আপ-টু-ডেট রাখতে হবে। তাই বলে জ্ঞানের পাহাড় হতে বলছি না। যেটুকু জ্ঞান অর্জন করেছি, বাস্তবে সেটাকেই সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হবে। নলেজ ইজ পাওয়ার, কিন্তু প্রপার ইমপ্লিমেন্টেশন অব নলেজ ইজ হর্স পাওয়ার।

ধৈর্য্য সহকারে তাঁর যাবতীয় বক্তব্য শুনতে হবে। তাঁর কথা শেষ হলে তবেই আপনি শুরু করবেন। মনে রাখতে হবে, কোনও মানুষ একটানা বেশি কথা বলতে পারে না। শ্রোতা চুপচাপ থাকলে বক্তার বাকশক্তি আপনা হতেই হ্রাস পায়। তার কথার মাঝে পাল্টা কথা বলা উচিত নয়।

আলোচনায় উত্তম কৌশল ও মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে হবে। আল্লাহ্তায়ালা পবিত্র কুরআনে বারংবার এই তাগিদ দিয়েছেন। খেয়াল রাখতে হবে সে যেন উত্তেজিত হয়ে না পড়ে। তাহলে মাঝপথে আলোচনার ছন্দপতন ঘটে যাবে। যার পরিণতি অদূর ভবিষ্যতে মারাত্মক আকার নিতে পারে।

আমরা বলব কম, শুনব বেশি। কারণ আল্লাহ্তায়ালা আমাদেরকে দুটি কান দিয়েছেন, কিন্তু মুখ দিয়েছেন একটি। প্রচণ্ড পড়াশোনা করতে হবে। পড়লে জানতে পারব যে, আমরা কত কী জানি না। আমি যা যা জানি, তা তো আমার জানাই রয়েছে। কিন্তু আমি যে কত কিছু জানি না, তা কি আমার জানা আছে? তাই পড়তে হবে। পড়ার কোনও বিকল্প নেই। মনে রাখতে হবে, রিডার ইজ লিডার।

 

বই মনের সই, বই জ্ঞানের মই। কুরআন শরীফে আল্লাহ্তায়ালার পক্ষ থেকে প্রথম যে শধটা নাযিল হয়েছিল, তা হল ‘ইকরা’, অর্থাৎ পড়ো। পড়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে গড়া যায়। এডুকেশন ইজ ফার্স্ট, এডুকেশন ইজ মাস্ট এবং এডুকেশন ইজ লাস্ট। পড়াশোনাই হল প্রকৃত মুসলমানের জিয়নকাঠি। শিক্ষার কোনও শেষ নেই। দোলনা থেকে খাটিয়া পর্যন্ত শিখতে হবে। তার থেকেও বড় কথা হল শেখার মানসিকতা রাখতে হবে। শুধুমাত্র শিক্ষা দিয়েই হয়ত সবসময় লক্ষ্য পূরণ হবে না। কিন্তু লক্ষ্য পূরণের জন্য শিক্ষা অর্জন জরুরি।

মানুষকে চিনতে হবে, জানতে হবে, বুঝতে হবে এবং বোঝাতে হবে। তাই আগে নিজেকে ভালোভাবে বুঝতে হবে। নিজে না বুঝলে অপরকে বোঝানো সম্ভব নয়। একটা মানুষের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ রিড করার দক্ষতা অর্জন করতে হবে। সেই মতো আপনার বক্তব্যের ডেলিভারি হবে।

নিজের রোজকার জীবনে চলা-বলা, ওঠা-বসা, আচার-আচরণের মধ্যে সততা, নৈতিকতা, মানবিকতার স্ফূরণ ও বিকাশ ঘটাতে হবে। আর এ সবের মধ্য দিয়েই আপনার সামনে বসা মানুষটির আস্থাভাজন হতে হবে। শুধুমাত্র তাঁকে একবার পবিত্র কুরআন কিংবা হাদিসের কিছু ভালো ভালো কথা শুনিয়ে দিলেই কাজ খতম হবে না। রীতিমতো ফলো-আপ এবং ফলো-থ্রু চালিয়ে যেতে হবে সারা জীবন ধরে। দাওয়াত একটা অনগোয়িং প্রসেস। দেখা মাত্র সৌজন্য ও কুশল বিনিময় করতে হবে। ইসলামের দাওয়াত অমুসলিমদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আলাদা করে খুব বেশি সময় ইনভেস্ট করার প্রয়োজন নেই। আমাদের দৈনন্দিন কাজের ফাঁকেই এটা চলতে থাকবে। কর্মস্থলে সহকর্মীদের কাছে এবং প্রতিবেশিদের কাছে ইসলামের বার্তা পৌঁছতে হবে। অপরিচিত লোকদের কাছেও একই কাজ করতে হবে। কারণ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে এই কাজের জন্য আল্লাহ্তায়ালা আমাদেরকেই বেছে নিয়েছেন। অন্য কোনও প্রাণীর এই দায় নেই।

সর্বোপরি, আমাদের কাছে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ জীবন-দর্শন রয়েছে। তাহলে আমরা আমাদের পরিচিতদের কাছে সেই বার্তা পৌঁছে দেব না কেন? আমার কাজ তো শুধু বলা। ফলাফল আল্লাহ্তায়ালা দেবেন। সে নিয়ে আমাদেরকে ভাবতে হবে না। হেদায়াত করার মালিক তো আসমান-জমিনের একচ্ছত্র অধিপতি আল্লাহ্। তিনি যেন আমাদেরকে দ্বীনের দায়ী হওয়ার তাওফিক দেন, আমীন!