১৯ এপ্রিল ২০২৫, শনিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

একটি সিজদার জন্য

বিপাশা চক্রবর্তী
  • আপডেট : ৩০ এপ্রিল ২০২২, শনিবার
  • / 4

আহমদ হাসান ইমরান: মসজিদুল আকসা। আল কুদস্ বা পবিত্র শহর জেরুসালেমে অবস্থিত ইসলামের তৃতীয় তীর্থভূমি আল কুদস্-এ রয়েছে এই মসজিদ। মক্কা ও মদিনার পরই ইসলামে স্থান হল মসজিদুল আকসার। ১৯৬৭ সাল থেকে এই পবিত্র শহর জেরুসালেম ও এখানে অবস্থিত মসজিদুল আকসা ইসরাইলিদের অবৈধ দখলে। আরব-ইসরাইল যুদ্ধে জর্ডনের হাত থেকে দখলদার ইসরাইলিরা এই পবিত্র এলাকা ছিনিয়ে নিয়েছিল।

এই সেই জেরুসালেম যা সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী ক্রসেডারদের হাত থেকে মুক্ত করেছিলেন এবং পবিত্র শহরটিকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছিলেন। জেরুসালেমের ধর্মীয় গুরুত্ব অপরিসীম। খ্রিষ্টান ও ইহুদিদের কাছে এই শহর পবিত্র বলে গণ্য। সালাহউদ্দীনের আইয়ুবীর সময় থেকে মুসলিমরা কখনই খ্রিষ্টানদের জেরুসালেমে এসে উপাসনা করতে বাধা দেয়নি। আর ‘যিশুর হত্যাকারী’ হিসেবে সমগ্র এই এলাকা থেকে অর্থাৎ জেরুসালেম ও পশ্চিম এশিয়া থেকে ইহুদিদের ঝাড়ে-বংশে খ্রিষ্টানরা বিতাড়িত করেছিল। সামান্য কিছু ইহুদি ফিলিস্তিন ও জেরুসালেমে পরে মুসলিম শাসনে ফিরে আসে। মুসলমানরা কখনই তাদের উপাসনায় বাধা দেয়নি। কিন্তু পরবর্তীতে (১৯৬৭ সালে) এই জায়নবাদী ইহুদিরা জেরুসালেমে দখলদারি কায়েম করার পর মসজিদুল আকসাকে নিজেদের পবিত্র স্থান বলে দাবি করতে থাকে। তারা ফিলিস্তিনের যে মুসলিমরা মসজিদুল আকসায় ইবাদত করার জন্য আসতে চায়, তাদের উপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে।

বিশেষ করে প্রতি রমযান মাসে তাদের এই তৎপরতা তুঙ্গে ওঠে। এছাড়া মসজিদুল আকসায় নামাযের উপর তারা নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে। এখানে শুধুমাত্র ৫০ বছর উর্ধ্ব ও ১২ বছরের নিচের বালকদের নামায ও ইবাদত করার অনুমতি রয়েছে। বাকিদের ইসরাইলি সেনা রাবারের বুলেট, লাঠি, কাঁদানে গ্যাস দিয়ে প্রতিবারই তাড়িয়ে দেয়। আর বয়স্কদের মধ্যেও সীমিত সংখ্যককেই তারা মসজিদুল আকসায় জুম্মার নামায পড়ার অনুমতি দিয়ে থাকে।

এখানে ফিলিস্তিনিদের প্রবেশে ইসরাইলি সেনার বিভিন্ন দূরত্বে বেশ কিছু চেকপোস্ট করেছে। তাদের নানা পাস দেখিয়ে এক একটি চেকপোস্ট পেরুবার চেষ্টা করতে হয়।

তবুও কিন্তু ফিলিস্তিনিদের মসজিদুল আকসায় নামায আদায় করার আকুতি হ্রাস পায়নি। অনেক সময় তাদের ইসরাইলি সেনাদের হাতে শহীদও হতে হয়েছে। কিন্তু তারা কখনই মসজিদুল আকসা থেকে দূরে সরে থাকেনি।

এবছর জুমাতুল বিদা-র একদিন আগেই ২৭-এ রমযানের রাত্রিতে হাজারে হাজারে মুসলিম তরুণরা ইসরাইলি সেনার সমস্ত চেকপোস্ট ও বাধা সরিয়ে মসজিদুল আকসার চত্বরে এবং লাগোয়া ডোম অফ দ্য রক-এর চারিপাশে ঢুকে পড়ে। তারা জুমাতুল বিদা-র নামাযের জন্য সেখানেই অবস্থান করতে থাকে। শেষ জুম্মাতে মসজিদুল আকসায় নামায আদায় করেন আড়াই লক্ষেরও উপর মুসল্লী। অবশ্য এই অর্জন সহজে হয়নি। ইসরাইলি সেনার হামলায় গুরুতর আহত হয়েছে কয়েক শত ফিলিস্তিনি। কিন্তু তারা জীবন বাজি রেখেও মসজিদুল আকসার পবিত্র চত্বর ছাড়েনি। সবথেকে বেশি আগ্রহ ও উৎসাহ দেখা গেছে ফিলিস্তিনি নারীদের। মসজিদুল আকসায় জুম্মার নামায আদায় ও ইবাদত করায় তাদের উৎসাহ ইহুদি সেনাদেরও অবাক করেছে। তাদের বক্তব্য, যদি মসজিদুল আকসার পবিত্র চত্বরে যেখানে নবী মুহাম্মদ সা.-সহ দুনিয়ার সমস্ত নবীরা নামায আদায় করেছেন, সেই গুরুত্বপূর্ণ স্থানে যদি একবার আল্লাহ্ উদ্দেশ্য সিজদা প্রদান করতে পারি, তবে জীবন সার্থক হয়।

জুমাতুল বিদা-র দিন ও তার আগে যে তরুণ-তরুণীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এবং সব বাধা পেরিয়ে মসজিদুল আকসার বিশাল প্রাঙ্গণে হাজির হতে পেরেছেন, তারা আনন্দ উদ্বেল হয়ে প্রথমে যে কাজটি করেছেন, তাহল যে যেখানে পেরেছেন যেভাবে পেরেছেন মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে আল্লাহ্ উদ্দেশে সিজদায় লুটিয়ে পড়েছেন।

এ প্রসঙ্গে একটি দৃশ্য সবাইকে আপ্লুত করেছে। কিছু তরুণ-তরুণী ইসরাইলি সেনাদের বাধা পেরিয়ে মসজিদুল আকসার পবিত্র চত্বরে প্রবেশ করা মাত্র অঝোর কান্নায় ভেঙে পড়ে সিজদা প্রদান করেছেন। বলেছেন গত ১০ বছর ধরে প্রতিবার রমযানে চেষ্টা করেছি। কিন্তু ইসরাইলি সেনার ব্যাটন ও অস্ত্রের মুখে পারিনি। আজ আল্লাহ আমাকে সফল করেছেন। তাই প্রবেশ করা মাত্র বহু প্রতীক্ষিত সিজদায় নত হয়েছি। ইনশাল্লাহ আল কুদস্ একদিন মুক্ত হবেই।

Copyright © Puber Kalom All rights reserved.| Developed by eTech Builder

একটি সিজদার জন্য

আপডেট : ৩০ এপ্রিল ২০২২, শনিবার

আহমদ হাসান ইমরান: মসজিদুল আকসা। আল কুদস্ বা পবিত্র শহর জেরুসালেমে অবস্থিত ইসলামের তৃতীয় তীর্থভূমি আল কুদস্-এ রয়েছে এই মসজিদ। মক্কা ও মদিনার পরই ইসলামে স্থান হল মসজিদুল আকসার। ১৯৬৭ সাল থেকে এই পবিত্র শহর জেরুসালেম ও এখানে অবস্থিত মসজিদুল আকসা ইসরাইলিদের অবৈধ দখলে। আরব-ইসরাইল যুদ্ধে জর্ডনের হাত থেকে দখলদার ইসরাইলিরা এই পবিত্র এলাকা ছিনিয়ে নিয়েছিল।

এই সেই জেরুসালেম যা সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবী ক্রসেডারদের হাত থেকে মুক্ত করেছিলেন এবং পবিত্র শহরটিকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছিলেন। জেরুসালেমের ধর্মীয় গুরুত্ব অপরিসীম। খ্রিষ্টান ও ইহুদিদের কাছে এই শহর পবিত্র বলে গণ্য। সালাহউদ্দীনের আইয়ুবীর সময় থেকে মুসলিমরা কখনই খ্রিষ্টানদের জেরুসালেমে এসে উপাসনা করতে বাধা দেয়নি। আর ‘যিশুর হত্যাকারী’ হিসেবে সমগ্র এই এলাকা থেকে অর্থাৎ জেরুসালেম ও পশ্চিম এশিয়া থেকে ইহুদিদের ঝাড়ে-বংশে খ্রিষ্টানরা বিতাড়িত করেছিল। সামান্য কিছু ইহুদি ফিলিস্তিন ও জেরুসালেমে পরে মুসলিম শাসনে ফিরে আসে। মুসলমানরা কখনই তাদের উপাসনায় বাধা দেয়নি। কিন্তু পরবর্তীতে (১৯৬৭ সালে) এই জায়নবাদী ইহুদিরা জেরুসালেমে দখলদারি কায়েম করার পর মসজিদুল আকসাকে নিজেদের পবিত্র স্থান বলে দাবি করতে থাকে। তারা ফিলিস্তিনের যে মুসলিমরা মসজিদুল আকসায় ইবাদত করার জন্য আসতে চায়, তাদের উপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে।

বিশেষ করে প্রতি রমযান মাসে তাদের এই তৎপরতা তুঙ্গে ওঠে। এছাড়া মসজিদুল আকসায় নামাযের উপর তারা নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে। এখানে শুধুমাত্র ৫০ বছর উর্ধ্ব ও ১২ বছরের নিচের বালকদের নামায ও ইবাদত করার অনুমতি রয়েছে। বাকিদের ইসরাইলি সেনা রাবারের বুলেট, লাঠি, কাঁদানে গ্যাস দিয়ে প্রতিবারই তাড়িয়ে দেয়। আর বয়স্কদের মধ্যেও সীমিত সংখ্যককেই তারা মসজিদুল আকসায় জুম্মার নামায পড়ার অনুমতি দিয়ে থাকে।

এখানে ফিলিস্তিনিদের প্রবেশে ইসরাইলি সেনার বিভিন্ন দূরত্বে বেশ কিছু চেকপোস্ট করেছে। তাদের নানা পাস দেখিয়ে এক একটি চেকপোস্ট পেরুবার চেষ্টা করতে হয়।

তবুও কিন্তু ফিলিস্তিনিদের মসজিদুল আকসায় নামায আদায় করার আকুতি হ্রাস পায়নি। অনেক সময় তাদের ইসরাইলি সেনাদের হাতে শহীদও হতে হয়েছে। কিন্তু তারা কখনই মসজিদুল আকসা থেকে দূরে সরে থাকেনি।

এবছর জুমাতুল বিদা-র একদিন আগেই ২৭-এ রমযানের রাত্রিতে হাজারে হাজারে মুসলিম তরুণরা ইসরাইলি সেনার সমস্ত চেকপোস্ট ও বাধা সরিয়ে মসজিদুল আকসার চত্বরে এবং লাগোয়া ডোম অফ দ্য রক-এর চারিপাশে ঢুকে পড়ে। তারা জুমাতুল বিদা-র নামাযের জন্য সেখানেই অবস্থান করতে থাকে। শেষ জুম্মাতে মসজিদুল আকসায় নামায আদায় করেন আড়াই লক্ষেরও উপর মুসল্লী। অবশ্য এই অর্জন সহজে হয়নি। ইসরাইলি সেনার হামলায় গুরুতর আহত হয়েছে কয়েক শত ফিলিস্তিনি। কিন্তু তারা জীবন বাজি রেখেও মসজিদুল আকসার পবিত্র চত্বর ছাড়েনি। সবথেকে বেশি আগ্রহ ও উৎসাহ দেখা গেছে ফিলিস্তিনি নারীদের। মসজিদুল আকসায় জুম্মার নামায আদায় ও ইবাদত করায় তাদের উৎসাহ ইহুদি সেনাদেরও অবাক করেছে। তাদের বক্তব্য, যদি মসজিদুল আকসার পবিত্র চত্বরে যেখানে নবী মুহাম্মদ সা.-সহ দুনিয়ার সমস্ত নবীরা নামায আদায় করেছেন, সেই গুরুত্বপূর্ণ স্থানে যদি একবার আল্লাহ্ উদ্দেশ্য সিজদা প্রদান করতে পারি, তবে জীবন সার্থক হয়।

জুমাতুল বিদা-র দিন ও তার আগে যে তরুণ-তরুণীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এবং সব বাধা পেরিয়ে মসজিদুল আকসার বিশাল প্রাঙ্গণে হাজির হতে পেরেছেন, তারা আনন্দ উদ্বেল হয়ে প্রথমে যে কাজটি করেছেন, তাহল যে যেখানে পেরেছেন যেভাবে পেরেছেন মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে আল্লাহ্ উদ্দেশে সিজদায় লুটিয়ে পড়েছেন।

এ প্রসঙ্গে একটি দৃশ্য সবাইকে আপ্লুত করেছে। কিছু তরুণ-তরুণী ইসরাইলি সেনাদের বাধা পেরিয়ে মসজিদুল আকসার পবিত্র চত্বরে প্রবেশ করা মাত্র অঝোর কান্নায় ভেঙে পড়ে সিজদা প্রদান করেছেন। বলেছেন গত ১০ বছর ধরে প্রতিবার রমযানে চেষ্টা করেছি। কিন্তু ইসরাইলি সেনার ব্যাটন ও অস্ত্রের মুখে পারিনি। আজ আল্লাহ আমাকে সফল করেছেন। তাই প্রবেশ করা মাত্র বহু প্রতীক্ষিত সিজদায় নত হয়েছি। ইনশাল্লাহ আল কুদস্ একদিন মুক্ত হবেই।