১৯ এপ্রিল ২০২৫, শনিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
BRAKING :
আশুরা:ইসলামের শাশ্বত চেতনাবোধের এক অনবদ্য প্রকাশ

ইমামা খাতুন
- আপডেট : ২৯ জুলাই ২০২৩, শনিবার
- / 3
পুবের কলম,ওয়েবডেস্ক: হিজরি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস মুহাররমের ১০ তারিখকে ‘আশুরা’ বলা হয়। দিনটি মুসলিম উম্মাহর কাছে বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত। আগামীকাল পবিত্র আশুরার প্রাক্কালে এ নিয়ে লিখছেন আবু তাহের
ইসলামি বর্ষপঞ্জি অনুসারে বছরের প্রথম মাস ‘মুহাররম’। মুহাররম আরবি শব্দ, যার অর্থ ‘সম্মানিত।’ নিষিদ্ধও বোঝায়। মুহাররম মাস ছাড়া ইসলামে রজব, যিলহজ ও যিলকদ এই তিনটি মাসও সম্মানিত। কুরআনে বর্ণিত আছে, ‘আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে আল্লাহ্র কাছে মাসের সংখ্যা ১২, তার মধ্যে ৪টি মাস (মুহাররম, রজব, যিলহজ ও যিলকদ) বিশেষভাবে সম্মানিত।’ (সূরা তাওবা, আয়াত:৩৬)
পবিত্র এই মাসগুলোতে ঝগড়া বিবাদ বা যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ। এই নিষিদ্ধ কর্মকাণ্ড থেকে মাসটি পাক ও মুক্ত বলে এ মাসকে পবিত্র ও সম্মানিত মাস বলা হয়। মুহাররম মাসের ১০ তারি’কে ‘আশুরা’ বলা হয়। এই বিশেষ দিনটিতে এমন অনেক ঘটনা সংগঠিত হয়, যা ইসলামের ইতিহাসে বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে আছে। পৃথিবী সৃষ্টির আবহমানকাল থেকে আশুরার দিনটি বিশেষ ঘটনা প্রবাহের ধারক। দিনটি মুসলিম উম্মাহর কাছে বিশেষ মর্যাদায় ভূষিত। যার ধারাবাহিকতা আজও বিদ্যমান। ১০ মুহাররম বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সা.-এর প্রিয় দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসেন রা.-এর শাহাদত দিবস হওয়ার সুবাদে বর্তমান আশুরার গুরুত্ব পেলেও ইসলামের ইতিহাসে এই দিনের অসংখ্য তাৎপর্যময় ঘটনা রয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে মুহাররম মাসের ১০ তারিখে বরকতময় এমন কিছু স্মৃতি জড়িয়ে আছে যা আমরা জানি না। এই স্মৃতিসমূহের সম্মানার্থেও মুহাররম মাসকে সম্মানিত মাস বলা হয়ে থাকে।
আশুরার দিনে মানবজাতির ইতিহাসে বহু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যবহুল ঐতিহাসিক ঘটনাসমূহের মধ্যে অন্যতম— এই দিনে পৃথিবী সৃষ্টি হয়, আবার এই দিনেই পৃথিবী ধ্বংস হবে। এই দিনে আল্লাহ্তায়ালা হযরত আদম আ.-কে ক্ষমা করেছিলেন। হযরত নূহ আ.-এর নৌকা মহাপ্লাবন থেকে রক্ষা পায়। নবী ইউনুস আ. মাছের পেট থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। এই দিনে বহু নবী-রাসূল জন্মগ্রহণ করেন। এই দিনেই হযরত মুসা সা. ফেরাউনের নির্মম অত্যাচার থেকে নিষ্কৃতি পান। হযরত ইব্রাহীম আ. নমরুদের অগ্নিকুণ্ড থেকে রেহাই পান। হযরত আইয়ুব আ. দীর্ঘ রোগভোগের পর আল্লাহর কৃপায় আরোগ্য লাভ করেন। সর্বোপরি এই দিনে প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সা.-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র ইমাম হোসেন রা. ইসলামের দুশমন ইয়াজিদের অপশাসন থেকে ইসলামের শাশ্বত ভাবনাকে সমুন্নত রা’তে কারবালায় শহিদের মৃত্যুবরণ করেন। যে মর্মান্তিক ঘটনা মুসলিম মানসে নিদারুন প্রভাব বিস্তার করে। অতীতে অনেক ঘটনা সংগঠিত হলেও হযরত ইমাম হোসেন রা.-এর আত্মত্যাগের ঘটনা সর্বাধিক আবেদনময়, বেদনাবহ ও তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে আছে কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনার জন্য। বাতিলের বিরুদ্ধে হক প্রতিষ্ঠা করতে সেদিনের সেই লড়াই দীপ্ত ত্যাগের মহিমায় আজও জাতির জীবনে অম্লান হয়ে আছে।
কারবালা প্রান্তরে অসম-যুদ্ধে হযরত হোসেন রা.-এর শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াইয়ের আকাঙ্ক্ষা ও আত্মবলিদানের অদম্য স্পৃহা এখনও মুসলিমদের মন ও মননে প্রেরণা জোগায়। কারবালা প্রান্তরে হৃদয়বিদারক ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইয়াজিদের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে একরাশ ক্ষোভ, ঘৃণা ও ইসলাম বিবর্জিত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মূল উৎপাটনে হযরত ইমাম হোসেন রা.-এর শাহাদতের মাধ্যমে জাতির প্রতি শিক্ষণীয় বার্তা। তাই তো কবির কণ্ঠে শোনা যায় ‘ইসলাম জিন্দা হতে হ্যায়, হর কারবালা কে বাদ।’
ইসলামে ইনসাফ-রাজ প্রতিষ্ঠায় স্বৈরাচারী-রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে হযরত ইমাম হোসেন রা.-এর শাহাদত বরণ ছিল কারবালার মর্মন্তুদ ঘটনার একমাত্র কারণ। নবী সা. পরবর্তী ‘ লোফতী শাসন-ব্যবস্থা অবৈধ পন্থায় অধিগ্রহণ করে ইয়াজিদের খামখেয়ালীপনার বিরুদ্ধে হযরত ইমাম হোসেন রা.-এর জিহাদ ছিল কারবালা ঘটনার প্রকৃত নির্যাস। আল্লাহর নবী সা.-কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সত্য, ধর্ম ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যে কল্যাণকামী রাষ্ট্রের পত্তন হয়, তা মুয়াবিয়া রা.-এর পুত্র ইয়াজিদের নিষ্ঠুর শাসন ব্যবস্থায় সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়ে। সত্যের আলো ক্রমশ ফিকে হয়ে আসে। এই বাতিলপন্থী ইয়াজিদের হাত থেকে সমূলে শাসনক্ষমতা উৎখাত করে ইসলামের হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনতে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেন ও শহিদের সম্মান লাভ করেন হোসেন রা.। ইচ্ছা করলেই হযরত ইমাম হোসেন রা. ইয়াজিদের আনুগত্য মেনে নিয়ে সপরিবারে সুখে জীবন কাটাতে পারতেন। কিন্তু না। আবাল্য লালিত নানাজী সা.-এর চারিত্রিক গুণে গুণান্বিত হযরত ইমাম হোসেন রা. আল্লাহ্র মনোনিত ধর্মকে কলঙ্কিত হতে দেবেন না। এটাই ছিল অভিযানের অন্তর্নিহিত সত্য। হযরত ইমাম হোসেন রা.-এর শাহাদত গোটা মানবজাতিকে শিক্ষা দিয়ে গিয়েছে-সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে অন্যায়, যুলুম উৎখাত করতে হলে প্রয়োজনে জীবন উৎসর্গ করতে কেউ যেন পিছুপা না হয়। হকের সঙ্গে বাতিলের আপস নয়, বরং বাতিলকে উৎখাত করার মধ্যে নিহিত আছে প্রকৃত কল্যাণ ও শান্তি।
বর্তমানে আশুরাকে সামনে রেখে কতিপয় মুসলিম আবেগের আতিশয্যে নানান ধরনের আস্ফালন করে থাকেন যা ইসলাম অনুমোদিত নয়। ইসলামের মৌলিক দর্শন- ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তি। সমাজে শান্তি, নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করা ও অধিকার রক্ষা করা। এই জীবনাদর্শ বিশ্বের সব মানুষের জন্য, যা প্রতিষ্ঠা করতে হযরত ইমাম হোসেন রা.-এর শাহাদত বরণ পবিত্র মুহাররম মাসের আশুরার দিনে।
ইমাম হোসেন রা. সত্য ও ন্যায়ের প্রতীক হয়ে বিশ্ব মুসলিমের হৃদয়-রাজ্যে বেঁচে থাকবেন। তাঁর আত্মত্যাগ মানুষ যুগ যুগ ধরে বক্ষে ধারণ করে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।
আশুরার রোজা
আশুরার দিনের নানান ঘটনার কৃতজ্ঞতায় এদিনের আমল হল রোযা পালন করা। আশুরার দিন পূর্ববর্তী আম্বিয়ায়ে কেরাম (আ.) রোযা রাখতেন। রমযানের রোযা ফরজ হওয়ার আগে উম্মতে মুহাম্মদির ওপর আশুরার রোযা ফরজ ছিল। হাদিসে বলা হয়েছে, ‘আশুরার দিনের সাওমের ব্যাপারে আমি আশা করি যে, তিনি পূর্ববর্তী এক বছরের পাপ মাফ করে দেবেন।’ (মুসলিম)। হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. আশুরা ও রমযানের রোযা সম্পর্কে যেরূপ গুরুত্ব প্রদান করতেন, অন্য কোনও রোযা সম্পর্কে সেরূপ গুরুত্ব আরোপ করতেন না (বুখারি ও মুসলিম)। হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেছেন, তোমরা আশুরার দিন (মুহাররমের দশম দিবস) রোযা রাখ এবং তাতে ইহুদিদের বিরুদ্ধাচরণ কর। আশুরার আগে একদিন বা পরে একদিন রোযা রাখ (মুসনাদে আহমদ)। সুতরাং মুহাররমের ১০ তারিখ ও তার আগের ৯ তারিখের সাওম পালন করা মুস্তাহাব। ৯ তারিখে সম্ভব না হলে দশম ও একাদশতম দিনে রোযা পালন করা যাবে।
হাদিসের বর্ণনা এবং সাহাবা কেরামের আমলে আশুরা উপলক্ষে রোযা পালনের আমলের কথাই পাওয়া যায়। অথচ এ পবিত্র দিনকে ঘিরে আমাদের সমাজে নানাবিধ কর্মকাণ্ড পরিলক্ষিত হয়। আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন আমাদের পবিত্র আশুরার তাৎপর্য অনুধাবন করে ইবাদাত-বন্দেগীর মাধ্যমে কাটানোর তাওফিক দান করুন।
Tag :