২৪ এপ্রিল ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ভুটানে দেড় বছরের ক্রীতদাস জীবন থেকে মুক্তি, দেশে ফিরলেন ৩ মুসলিম শ্রমিক

বিপাশা চক্রবর্তী
  • আপডেট : ২ জুলাই ২০২১, শুক্রবার
  • / 6

আসিফ রেজা আনসারী

রাজু হক– নূরজামাল হক ও আলি হোসেন আলিপুরদুয়ার জেলার মাদারিহাট ব্লকের বাসিন্দা। তাঁরা সকলেই পরিযায়ী শ্রমিক। বাড়িতে ‘নুন আনতে পান্তা ফুরানো’ অবস্থা। সামান্য টাকার বিনিময়ে চলে যান কাজ করতে। সে ভিন্নরাজ্যই হোক বা সীমান্ত পার করে নেপাল-ভুটান। দিনরাত গায়ে-গতরে খেটে সংসার চালানো মানু¡গুলো আদৌ জানতেন না যে– ভুটানে রাজমিস্ত্রির কাজ করতে গিয়ে কাটাতে হবে বছর দেড়েকের বন্দি-জীবন। কাজ করেও মিলবে না কোনও পারিশ্রমিক।

তাঁদের এই করুণ কাহিনি জানতে পারেন পেশায় আইটি প্রফেশনাল ও সমাজকর্মী সাদিকুল ইসলাম। তাঁর চেষ্টাতেই ঘরে ফিরলেন তিন পরিযায়ী শ্রমিক। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তাঁরা ফুন্টসেলিং-জয়গাঁও সীমান্ত পেরিয়ে দেশে প্রবেশ করেন। বাড়ি ফিরে শ্রমিকরা বলেন–  আমরা আমাদের অসহায় অবস্থার কথা অনেককেই বলেছিলাম– কিন্তু কাজ হচ্ছিল না। সাদিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ হওয়ার পর সাহস পাই। তদন্ত শুরু হলে মুক্তির আশা জাগতে থাকে। এবার ফিরতে পারলাম খুব ভালো লাগছে। দেশে ফেরানোর জন্য সাদিকুল ইসলাম ও সমস্ত আধিকারিকদের ধন্যবাদও জানান রাজু হক– নূরজামাল হক ও আলি হোসেনরা।

জানা গিয়েছে– গত দেড় বছর ধরে দেশে ফিরতে পারছিলেন না এ রাজ্যের তিন শ্রমিক। পেটের টানে ভুটানে পাড়ি দিয়েছিলেন। সেই থেকে ওখানে আটকে যান এই পরিযায়ী শ্রমিকরা।

এ নিয়ে সাদিকুল ইসলাম বলেন–  এক মাস আগে ম্যাসেঞ্জারের মাধ্যমে এক ব্যক্তি ঘটনাটি সম্পর্কে আমাকে অবহিত করেন। আমি ফোন নম্বর জোগাড় করে ভুটানে থাকা ওই পরিযায়ী শ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করি।

ভুটানে আটকে থাকা শ্রমিকরা অভিযোগ করেন– এখানকারই তাঁদের এক পরিচিত ব্যক্তির সূত্রে ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে কাজ করতে যান। ওই পরিচিত ব্যক্তিটি ভুটানের ওয়ার্কিং সাইটে সুপার ভাইসরের কাজ করতেন। কাজের মাঝামাঝি সময়ে তিনি হঠাৎই টাকা পয়সা ও কাজের কোনও হিসাব ভুটানের মালিককে না দিয়েই উধাও হন। তাঁর মারফত এই তিনজন শ্রমিক যেহেতু  কাজে গিয়েছিলেন– তাই তাঁদের আটকে দেওয়া হয়। অন্যের অপরাধের সাজা পেতে হয় এদের।

রাজু হক–  নূরজামাল হক ও আলি হোসেনরা আরও জানান– ভুটানের মালিক তাঁদের পাসপোর্ট ও যাবতীয় নথিপত্র কেড়ে নেন এবং সেগুলো ফেরৎ নিতে হলে ৩ লাখ টাকা দাবি করেন। টাকা দিতে না পারার জন্য রীতিমতো বেগার ক্রীতদাস বানিয়ে রাখেন। মালিক দাবি করেন–  যতদিন না ওই সুপার ভাইসর তাঁর টাকা ও সমস্ত হিসাব-নিকেশ মেটাচ্ছে– ততদিন শ্রমিকরা দেশে ফিরতে পারবেন না। তাঁদের কাগজপত্র কেড়ে নেওয়া হয়েছিল ফলে তাঁরা কিছুই করতে পারছিলেন না।

এরপরই সাদিকুল বিষয়টা জানতে পারেন। সাদিকুল ইসলাম বলেন– সব কথা শোনার পর আমি এ দেশের বিদেশমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করি। আমার পূর্ব পরিচিত ভারতের বিদেশমন্ত্রকের এক অফিসারকে বিষয়টা জানাই। তাঁদের মাধ্যমেই ভারতের ভুটান দূতাবাসে খবরটি যায়– ভুটানের ফরেন অ্যাফেয়ার্স ও শ্রমমন্ত্রকের তত্ত্বাবধানে পুলিশি তদন্ত শুরু হয়।

সাদিকুল বলেন– তদন্তের সময় ওখানকার মালিক জোর করে আটকে রাখা ও ক্রীতদাস বানিয়ে রাখার কথা অস্বীকার করলেও প্রশাসনিক চাপে পরিযায়ী শ্রমিকদের ওপর অত্যাচার বন্ধ করতে বাধ্য হন। সরকারি সমস্ত তদন্ত ও কাগজপত্রের কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত সুস্থভাবে তাঁদের থাকার বন্দোবস্ত করে দেন মালিক। গত ২৯ জুন ওই মালিক আটক তিন পরিযায়ী শ্রমিকের সঙ্গে আলোচনা করে বিগত সব বকেয়া মিটিয়ে দেন। সরকারি সব প্রটোকল শেষ করে ১ জুলাই ঘরে ফিরলেন ওই তিন পরিযায়ী শ্রমিক। প্রশাসনের তরফে তাঁদের প্রত্যকে নিজের বাড়িতে পৌঁছানো হয়।

Tag :

Copyright © Puber Kalom All rights reserved.| Developed by eTech Builder

ভুটানে দেড় বছরের ক্রীতদাস জীবন থেকে মুক্তি, দেশে ফিরলেন ৩ মুসলিম শ্রমিক

আপডেট : ২ জুলাই ২০২১, শুক্রবার

আসিফ রেজা আনসারী

রাজু হক– নূরজামাল হক ও আলি হোসেন আলিপুরদুয়ার জেলার মাদারিহাট ব্লকের বাসিন্দা। তাঁরা সকলেই পরিযায়ী শ্রমিক। বাড়িতে ‘নুন আনতে পান্তা ফুরানো’ অবস্থা। সামান্য টাকার বিনিময়ে চলে যান কাজ করতে। সে ভিন্নরাজ্যই হোক বা সীমান্ত পার করে নেপাল-ভুটান। দিনরাত গায়ে-গতরে খেটে সংসার চালানো মানু¡গুলো আদৌ জানতেন না যে– ভুটানে রাজমিস্ত্রির কাজ করতে গিয়ে কাটাতে হবে বছর দেড়েকের বন্দি-জীবন। কাজ করেও মিলবে না কোনও পারিশ্রমিক।

তাঁদের এই করুণ কাহিনি জানতে পারেন পেশায় আইটি প্রফেশনাল ও সমাজকর্মী সাদিকুল ইসলাম। তাঁর চেষ্টাতেই ঘরে ফিরলেন তিন পরিযায়ী শ্রমিক। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তাঁরা ফুন্টসেলিং-জয়গাঁও সীমান্ত পেরিয়ে দেশে প্রবেশ করেন। বাড়ি ফিরে শ্রমিকরা বলেন–  আমরা আমাদের অসহায় অবস্থার কথা অনেককেই বলেছিলাম– কিন্তু কাজ হচ্ছিল না। সাদিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ হওয়ার পর সাহস পাই। তদন্ত শুরু হলে মুক্তির আশা জাগতে থাকে। এবার ফিরতে পারলাম খুব ভালো লাগছে। দেশে ফেরানোর জন্য সাদিকুল ইসলাম ও সমস্ত আধিকারিকদের ধন্যবাদও জানান রাজু হক– নূরজামাল হক ও আলি হোসেনরা।

জানা গিয়েছে– গত দেড় বছর ধরে দেশে ফিরতে পারছিলেন না এ রাজ্যের তিন শ্রমিক। পেটের টানে ভুটানে পাড়ি দিয়েছিলেন। সেই থেকে ওখানে আটকে যান এই পরিযায়ী শ্রমিকরা।

এ নিয়ে সাদিকুল ইসলাম বলেন–  এক মাস আগে ম্যাসেঞ্জারের মাধ্যমে এক ব্যক্তি ঘটনাটি সম্পর্কে আমাকে অবহিত করেন। আমি ফোন নম্বর জোগাড় করে ভুটানে থাকা ওই পরিযায়ী শ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করি।

ভুটানে আটকে থাকা শ্রমিকরা অভিযোগ করেন– এখানকারই তাঁদের এক পরিচিত ব্যক্তির সূত্রে ভুটানের রাজধানী থিম্পুতে কাজ করতে যান। ওই পরিচিত ব্যক্তিটি ভুটানের ওয়ার্কিং সাইটে সুপার ভাইসরের কাজ করতেন। কাজের মাঝামাঝি সময়ে তিনি হঠাৎই টাকা পয়সা ও কাজের কোনও হিসাব ভুটানের মালিককে না দিয়েই উধাও হন। তাঁর মারফত এই তিনজন শ্রমিক যেহেতু  কাজে গিয়েছিলেন– তাই তাঁদের আটকে দেওয়া হয়। অন্যের অপরাধের সাজা পেতে হয় এদের।

রাজু হক–  নূরজামাল হক ও আলি হোসেনরা আরও জানান– ভুটানের মালিক তাঁদের পাসপোর্ট ও যাবতীয় নথিপত্র কেড়ে নেন এবং সেগুলো ফেরৎ নিতে হলে ৩ লাখ টাকা দাবি করেন। টাকা দিতে না পারার জন্য রীতিমতো বেগার ক্রীতদাস বানিয়ে রাখেন। মালিক দাবি করেন–  যতদিন না ওই সুপার ভাইসর তাঁর টাকা ও সমস্ত হিসাব-নিকেশ মেটাচ্ছে– ততদিন শ্রমিকরা দেশে ফিরতে পারবেন না। তাঁদের কাগজপত্র কেড়ে নেওয়া হয়েছিল ফলে তাঁরা কিছুই করতে পারছিলেন না।

এরপরই সাদিকুল বিষয়টা জানতে পারেন। সাদিকুল ইসলাম বলেন– সব কথা শোনার পর আমি এ দেশের বিদেশমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করি। আমার পূর্ব পরিচিত ভারতের বিদেশমন্ত্রকের এক অফিসারকে বিষয়টা জানাই। তাঁদের মাধ্যমেই ভারতের ভুটান দূতাবাসে খবরটি যায়– ভুটানের ফরেন অ্যাফেয়ার্স ও শ্রমমন্ত্রকের তত্ত্বাবধানে পুলিশি তদন্ত শুরু হয়।

সাদিকুল বলেন– তদন্তের সময় ওখানকার মালিক জোর করে আটকে রাখা ও ক্রীতদাস বানিয়ে রাখার কথা অস্বীকার করলেও প্রশাসনিক চাপে পরিযায়ী শ্রমিকদের ওপর অত্যাচার বন্ধ করতে বাধ্য হন। সরকারি সমস্ত তদন্ত ও কাগজপত্রের কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত সুস্থভাবে তাঁদের থাকার বন্দোবস্ত করে দেন মালিক। গত ২৯ জুন ওই মালিক আটক তিন পরিযায়ী শ্রমিকের সঙ্গে আলোচনা করে বিগত সব বকেয়া মিটিয়ে দেন। সরকারি সব প্রটোকল শেষ করে ১ জুলাই ঘরে ফিরলেন ওই তিন পরিযায়ী শ্রমিক। প্রশাসনের তরফে তাঁদের প্রত্যকে নিজের বাড়িতে পৌঁছানো হয়।