নৃশংস হত্যা,উচ্ছেদে বধ্যভূমি অসম। বেশ কয়েকটি মর্মান্তিক ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়েছে দুনিয়াজুড়ে টেলিভিশন ও সোশ্যাল মিডিয়ায়।
- আপডেট : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২১, রবিবার
- / 4
আহমদ হাসান: অসমের দরং জেলার সিপাঝারের ধলপুর ও পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলিতে যে বর্বর ও নৃশংসতার মাধ্যমে দরিদ্র মানুষের প্রায় ৮৫০টি বাড়ি ভেঙে দেওয়া হয়– অমানুষিক মারধর– গ্রামের শিশু-নারী-পুরুষ– বৃদ্ধের উপর অত্যাচার চলার ঘটনা ও বেপরোয়া গুলি চালনায় কমপক্ষে ৩ জন নিহত ও আহতদের কথা এখন সারাবিশ্ব জেনে গেছে। বেশ কয়েকটি মর্মান্তিক ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়েছে দুনিয়াজুড়ে টেলিভিশন ও সোশ্যাল মিডিয়ায়।
আমি নিজে একটি ভিডিয়ো ক্লিপ পুরোপুরি দেখার মতো সাহস ও সহ্যশক্তি অর্জন করতে পারিনি। যে অর্ধেক ভিডিয়ো ক্লিপ দেখেছি তাতে দেখা যাচ্ছে– কয়েকটি বাড়ি ভাঙার জন্য পুলিশ দল লাঠি ও বন্দুক উঁচিয়ে জড়ো হয়েছে। বাড়িগুলি থেকে আর্তনাদ– আহাজারি– কান্না ভেসে আসছে। বিশেষ করে মেয়েদের আর্তনাদ। যেখানে তারা ১৯৭৩-র আগে এসে ঘরবাড়ি বানিয়েছেন– ভোট দিয়েছেন– আজ দস্যুর মতো হানা দিয়ে শত শত পুলিশ সেগুলিকে ভাঙছে। একটি ভিডিয়োতে দেখলাম– পুলিশ বাড়ি ভেঙে আসবাবপত্রে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে। প্রথম ভিডিয়োটিতে দেখেছি– এই বর্বর কাণ্ড সহ্য করতে না পেরে খালি হাতে একজন তরুণ পুলিশদের কাছে কাকুতি-মিনতি শুরু করল। আর যায় কোথায়! সেই তরতাজা তরুণটিকে ভাঙা বাড়ির দরজার কাছে মাটিতে ফেলে পুলিশ লাঠি ও রাইফেল দিয়ে নৃশংসভাবে পেটানো শুরু করল। আর তার বাড়ির কিশোর-কিশোরী– বোন-মা এবং অন্যান্য আত্মীয়দের কি মর্মান্তিক কান্না ও চিৎকার! কিন্তু পুলিশি বর্বরতার কোনও কমতি নেই। এই দৃশ্য দেখা যায় না– এই বিপন্ন আওয়াজ শোনা যায় না। তরুণটি বেঁচে আছে কি না– কে জানে! এরকম বেশ কয়েকটি ভিডিয়ো এখন ছড়িয়ে পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায় ও টেলিভিশনে।
ওই অঞ্চলে আজ থেকে প্রায় ৪৫-৫০ বছর আগে বাংলামূলের মুসলিমরা কয়েকটি গ্রাম তৈরি করে অনাবাদি জমিতে চাষবাস শুরু করে। অসমে ব্রহ্মপুত্রের কোলে চরগুলিতে কিংবা নদীর পাশে এই ধরনের আরও গ্রাম রয়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদ-এর অসংখ্য চরের মধ্যে এদের বসত। কিন্তু ১০-১২ বছর পর নদীর চর ভাঙে এবং অন্য জায়গায় গড়ে ওঠে। চর ভেঙে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে সেখানকার অধিবাসীরা নতুন চরে বা অন্য জায়গায় গিয়ে বসত করতে বাধ্য হন। এই অঞ্চলেও এই ধরনের নদীর চর থেকে উৎখাত হওয়া এই ধরনের মানুষরা বসত করেছিলেন। এদের বৈধ ভোটার কার্ড– আধার কার্ড সবই রয়েছে। নতুন যে এনআরসি তালিকা হয়েছে তাতেও কিন্তু এদের নাম রয়েছে ভারতীয় হিসেবে। অর্থাৎ এরা ভারতীয়। বাংলাদেশ বা আরব থেকে আসেনি। তাহলে কেন এদের উৎখাত করা হচ্ছে? আর হিমন্ত সরকার তাদের পূর্বের হুমকি অনুযায়ী যদি এদের উৎখাত করার পরিকল্পনা নিয়ে থাকে– তাহলে কেন এদের জন্য সরকার বিকল্প কোনও সংস্থান করল না? এই প্রশ্ন এখন অসমের সবার মুখে। কেন মাত্র ১২ ঘণ্টার নোটিশে এদেরকে আচমকা শত শত পুলিশ এনে অমানবিকভাবে উৎখাত করা হল? সাংবাদিকদের বর্ণনা মতে– প্রায় ৮৫০টি ঘর ভাঙা হয়েছে। আর এর বাসিন্দা ৪০-৪৫ হাজার মানুষ এই প্রবল বর্ষার মধ্যে অভুক্ত অবস্থায় এখন খোলা আকাশের নিচে।
ভারতীয় নাগরিকদের খাদ্য– বস্ত্র– বাসস্থান জোগানোর দায়িত্ব সরকারের। এই দায়িত্ব পালন না করে শুধুমাত্র এক ধর্মের মানুষকে টার্গেট করা প্রকৃতই সরকারি সন্ত্রাস। যা জাতি বিদ্বেষ থেকে তৈরি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিদেশে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সবথেকে জোরদার প্রবক্তা হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেছেন। আর দেশের মধ্যে যে সরকারি সন্ত্রাস চলছে– সে সম্পর্কে তিনি নিশ্চুপ। এই সরকারি সন্ত্রাসকেও সমানভাবে নিন্দা করতে হবে। সবথেকে দুঃখজনক হচ্ছে– নতুন স্বয়ংসেবক মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার এই ধরনের হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞে প্ররোচনা। আগে আইন– সংবিধান ও নির্দিষ্ট এক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে তাঁর বহু মন্তব্য ‘পুবের কলম’-সহ নানা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
একটি ভালো খবর হচ্ছে– সিপাঝারের ঘটনায় অসমের হিন্দু-মুসলিম সকল ধর্মের মানুষ প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে। কিন্তু হিমন্ত বিশ্ব শর্মার ভাই দরং-এর পুলিশ সুপার মন্তব্য করেছেন– আমাদের যে কাজ দেওয়া হয়েছিল তা করার জন্য যা যা প্রয়োজন– তা পুলিশ করেছে। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীও একই কথা বলেছেন। তিনি বলেন– ‘পুলিশ তার দায়িত্ব পালন করেছে মাত্র।’ ব্যাপক প্রতিবাদ না হলে সেই নির্দয় সরকারি ফোটোগ্রাফারটিকেও গ্রেফতার করা হত না। অসম পুলিশের ডিজি বলেছেন– তিনি মরণাপন্ন একজন ভিক্টিম মঈনুলের উপর যেভাবে ওই ফোটোগ্রাফার বর্বর অত্যাচার করছিলেন– তা দেখার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাঁকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। অর্থাৎ সরকারের এক শীর্ষ আধিকারিকও এই নৃশংসতা সহ্য করতে পারেননি। কিন্তু অবিচল মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবাবু। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন– এত অল্প সময়ে সেখানে প্রায় ১০ হাজার মানুষ কি করে জমায়েত হল? হিমন্তবাবুকে যদি কেউ প্রশ্ন করেন– তাদের এতদিনের ঘরবাড়ি থেকে জবরদস্তি বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করতে আসবে– আর মানুষ সেখানে জড়োও হতে পারবে না! ওই অঞ্চলে প্রায় ৪০-৫০ হাজার মানুষের বাড়িঘর ভেঙে দেওয়ার মতো সন্ত্রাস হয়েছে। কিন্তু ফ্যাসিবাদী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার বক্তব্য হচ্ছে– আমরা আমাদের কর্তব্য করছি। তোমরা কেন জড়ো হবে– প্রতিবাদ করবে! আসলে ফ্যাসিবাদীরা এরকমই ভাবে। সন্ত্রাসবাদীরাও তাই। মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার নির্দেশে গত তিন মাসে পুলিশ অপরাধী সন্দেহে প্রায় ২০-২২ জনকে হত্যা করেছে। হিমন্ত পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন– অপরাধী মনে হলেই ধরো আর মারো। আমি তোমাদেরকে পুরো স্বাধীনতা দিলাম। অর্থাৎ হিমন্তবাবুরা আদালতে বিচার করার পর্বটি তুলে দিতে চাইছেন। পুলিশের গুলিতে যেসব তথাকথিত ‘অপরাধীরা’ মারা গেছে তাদের বেশিরভাগই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। পুলিশের আর কাউকে আইনের সোপর্দ করার দায়িত্ব রইল না। কারণ– হত্যা করার লাইসেন্স স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী তাদের হাতে তুলে দিয়েছেন। মানবাধিকার সংগঠনগুলির প্রতিবাদ সত্ত্বেও আইন-বহির্ভূত হত্যা চালানোর নির্দেশকে নির্লজ্জ ভাষায় হিমন্ত সমর্থন করে যাচ্ছেন।
এ দিকে অসমের হিন্দুরা এই ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক হিসেবে দেখছেন না। তাঁরা সিপাঝার হত্যা ও উচ্ছেদ অভিযানকে সরকার ও পুলিশের বর্বরতা হিসেবে অভিহিত করছেন। কিন্তু ‘লাগে রহ মুন্নাভাই’-এর মতো হিমন্ত বিশ্ব শর্মা যে আছেন। তিনি ওই অঞ্চলে মুসলমানদের অবস্থানকে সেখানকার একটি মন্দিরের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য– মুসলমানরা ওই মন্দিরকেই নাকি দখল করতে চলেছে। আর তাই তিনি…। ভারতে এবং অসমে বহু জায়গায় পাশাপাশি মন্দির ও মসজিদ রয়েছে। তাতে ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিদের কোনও অসুবিধা হয় না। কিন্তু যেকোনও ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক রং দিয়ে উত্তেজনা তৈরি করার মাস্টার হচ্ছেন হিমন্ত বিশ্ব শর্মা। সাম্প্রদায়িক গোরবে ভরা তাঁর উর্বর মস্তিষ্ক থেকে নানা রকম মিথ্যা তথ্য ও তত্ত্ব প্রায় প্রতিদিনই নির্গত হচ্ছে।
হিমন্তবাবুকে প্রশ্ন করতে হয়– অসমের মুসলিমরা কি মানুষ পদবাচ্য? বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার চোখে– মন-মানসিকতার এবং ক্ষমতার অপব্যবহারে কিন্তু মুসলিমদের তিনি ‘অবাধ বধযোগ্য’ বলে হয়তো মনে করেন। এক সময়ের আলফা সংশ্লিষ্ট– পরে কংগ্রেস নেতা-মন্ত্রী এবং শেষে আরএসএস-বিজেপির নৃশংস পদাধিকারী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা ভারতের সংবিধানকে উপেক্ষা করে যা করে চলেছেন– তা কেবল বিখ্যাত ফ্যাসিবাদীদের সঙ্গে তুলনীয়। কিন্তু তাও কি বলা যাবে! নাৎসিবাদী হিটলারকে বলা হয় তিনি নাকি ইহুদি নিধনের প্রাণপুরুষ। হিটলার কি ইহুদি নিধনে যেসব কথা বলেছেন– হিমন্ত হয়তো তাও ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকেও তিনি সম্পূর্ণ লঙ্ঘন করে চলেছেন। লঙ্ঘন করছেন দেশের শীর্ষ আদালতের আদেশকেও। সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল– এই কোভিড মহামারির মধ্যে কাউকে উচ্ছেদ করা যাবে না। হয়তো হিমন্ত শীর্ষ আদালতের রায়কেও ‘মান্য’ বলে মনে করেন না। হিমন্ত মুখ্যমন্ত্রী হয়েও বেপরোয়াভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও মানুষ হত্যায় উৎসাহ দিয়ে চলেছেন।