১৯ এপ্রিল ২০২৫, শনিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

দেশভাগের যন্ত্রণা এ বয়সেও দগ্ধ করে, একান্ত সাক্ষাৎকারে শীর্ষেন্দু

বিপাশা চক্রবর্তী
  • আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২৩, মঙ্গলবার
  • / 8

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়-এর (ছবি- রমিত বন্দ্যোপাধ্যায়)

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। মায়ের ভাষা বাংলাকে রক্ষার জন্য আন্দোলন হয়েছিল। রক্তস্নাত হয়েছিল ঢাকার রাজপথ। জোর করে উর্দু চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। পশ্চিম পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা। এই দাবিতে শুরু হয়েছিল আন্দোলন। সেই আন্দোলন বুলেট দিয়ে দমানোর চেষ্টা করেছিল পাক সেনা। প্রাণ দিয়েছিলেন সালাম, রফিক, জব্বার, শফিউর-সহ বাংলা মায়ের বহু দামাল ছেলে। ভাষার জন্যও যে এভাবে অকাতরে প্রাণ দেওয়া যায়, তা প্রথম দেখেছিল তামাম দুনিয়া। ইউনেস্কোর স্বীকৃতির ফলে ১৯৯৯ সাল থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে সারাবিশ্বে।

 

২১শে ফেব্রুয়ারির প্রাক্-লগ্নে ‘পুবের কলম’-এর প্রতিনিধি অর্পিতা লাহিড়ীকে দেওয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে বিশিষ্ট সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় জানালেন দেশভাগের যন্ত্রণা আজও তাঁকে দগ্ধ করে, আলাপচারিতায় উঠে এলো আরও নানা প্রসঙ্গ।

 

 

১৯৩৫ সালে অবিভক্ত বাংলার ময়মনসিংহে আপনার জন্ম, মাত্র ১১ বছর কাটিয়েছেন সেখানে। এরপর চলে আসা কলকাতায়। বাবার চাকরি সূত্রে কৈশোর এবং যৌবনের বড় অংশ অসমে কাটিয়েছেন। দেশভাগ দেখেছেন। সেই অনুভূতি যদি শেয়ার করেন।

 

শীর্ষেন্দু: দেখো, দেশভাগের যন্ত্রণা এই বয়সেও অনুভব করি। আমাদের কাছ থেকে দেশটা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। সেটা ভুলতে পারি না। ভিখিরিরও একটা তোবড়ানো অ্যালুমিনিয়ামের বাটি থাকে। যেটা তার একান্ত। নিজস্ব। সেটুকুও কেড়ে নেওয়া হলে তা দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। এই একই অবস্থা আমাদেরও হয়েছিল। যেটুকু ছিল, তাও কেড়ে নেওয়া হল। মতামতের তোয়াক্কা না করে। কিছু মানুষের সিদ্ধান্ত আমাদের ঘটিবাটিমাটি চাটি করে দিল। এটা আমাদের কাছে অসহনীয় লেগেছিল, আজও লাগে। তোমার অধিকার নেই। এটা কম অপমান নয়। এটা জনগণের মতামত নিয়ে তৈরি হয়েছিল বলে আমার মনে হয় না। কিছু নেতানেত্রী নিজেদের বাহবা কুড়োনোর জন্য দেশভাগের সব শর্ত মেনে নিয়েছিল। তারা চেয়েছিল নিজেদের কৃতিত্ব দেখাতে। সেই কৃতিত্বের অধিকারী তারা হল। তবে কোটি কোটি মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে। ভিটে হারানোর যন্ত্রণাটা যে কত মর্মান্তিক, তা ভিটে যে হারিয়েছে, সে ছাড়া আর কেউ বুঝবে না। আমরা বুঝি।

 

অসমেও বাংলা ভাষা আন্দোলন হয়েছিল ১৯৬১ সালের ১৯ মে। বাংলা ভাষা আন্দোলনে ১১ জন শহিদ হয়েছিলেন। শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে অসম পুলিশ বাংলাভাষীদের গুলি করে। পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষার জন্য যে আন্দোলন, তা মাতৃভাষা আন্দোলনের স্বীকৃতি পায়। কিন্তু ভারতের শিলচরে তাঁরা ভাষা শহিদ হলেন, সেই প্রাপ্য মর্যাদা তাঁরা পেলেন না কেন?

 

শীর্ষেন্দু: মর্যাদাটা আমরা দিইনি, কিন্তু দেওয়া উচিত। বিষয়টা হাইলাইটেড হয়নি। ওদের (অসমিয়া) একটা ভয় আছে। ওরা ভাষাগত দিক থেকে সংখ্যালঘু হয়ে যাচ্ছে। অসমে একটা বাঙালি বিদ্বেষ তৎকালেও ছিল। এখনও কতটা আছে আমি জানি না। যেহেতু পাকিস্তান থেকে লোক আসছে, সেটা ওদের কাছে আতঙ্কের হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিশেষ করে কাছার, সেটি ছিল বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চল। এটাকে তো অসম বলে মনেই হয় না, এটিকে তো আলাদা রাজ্য করে দেওয়া যেতই। ভাষা শহিদ কিন্তু প্রথম অসমেই হয়। এটাকে আমরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। বাংলাদেশ ভাষাভিত্তিক দেশ। তবে আমাদের আশা ছিল বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হবে, কিন্তু নিরপেক্ষ থাকল কোথায়? তবে বাংলা ভাষা ভিত্তিক দেশ হয়েছে, সেটা আমাদের কাছে খুব আনন্দের।

 

‘পার্থিব’ উপন্যাসে আপনি দেশভাগের ছবি একেছেন। বাসা ভাঙার কথা বলেছেন, যদি সাহিত্যিক না হতেন, বাংলা ভাষাকে যদি আঁকড়ে না ধরতেন, তাহলে কীভাবে এই কুরে কুরে খাওয়া দেশভাগের যন্ত্রণাটাকে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন?

 

শীর্ষেন্দু: দেখো, যার মাধ্যম আছে সে তার প্রকাশ করে। আমি যদি আজ না লিখতাম, তাহলে সেটা পারতাম না। বেদনা সবার মধ্যেই থাকে, কিন্তু সেটা সবাই প্রকাশ করতে পারে না।

 

আজকাল বাংলা ভাষায় হিন্দির অনুপ্রবেশ হচ্ছে, এটা কি বিপজ্জনক প্রবণতা?

শীর্ষেন্দু: দেখো, ভাষা একটা চিরপরিবর্তনশীল জিনিস। ভাষা পরিবর্তিত হবেই, অন্য ভাষার প্রভাবে ভাষার মধ্যে পরিবর্তন আসবেই, শধ ঢুকে যাবে, ভালো করে খেয়াল করে দেখলে দেখবে তুমি এখন ইংরিজি ভাষার মধ্যে প্রচুর বাংলা শব্দ পাবে। বারান্দা, পাজামা, ইংরেজি শধের মধ্যে শ্বশুর শাশুড়িও ঢুকে যাচ্ছে। একটা ভাষা একটা ভাষা থেকে ধার করে।

 

আপনার লেখার মধ্যে একটা আধাত্ম্যবাদের প্রভাব পাই, সেটা নিয়ে কী বলবেন।

শীর্ষেন্দু: আমি নিজে ওই পথে চলার চেষ্টা করি। আমার জীবনে গুরুর মস্তবড় প্রভাব আছে। আমি নিজে থেকে কিছু করি না। ওটা চলেই আসে।

 

শিশু-কিশোরদের মধ্যে কি বাংলা পড়ার প্রবণতা কমছে?

শীর্ষেন্দু: দেখো, রবীন্দ্রনাথ নিজের লেখা বইয়ের কপি ৫০০ ছাপার কথা বলছেন এক জায়গায়। আগেও বাঙালি পড়ত না, এখনও তার পড়ার অভ্যাস নেই। তবে এখন বইমেলার কল্যাণে পরিস্থিতি খানিকটা বদলেছে। প্রকাশকরা এখন বই প্রকাশের সৌজন্যে বিদেশ পর্যন্ত যাছেন।

অনেক ধন্যবাদ আমাদের এতটা সময় দেওয়ার জন্য।

শীর্ষেন্দু: ধন্যবাদ তোমাদেরও।

Copyright © Puber Kalom All rights reserved.| Developed by eTech Builder

দেশভাগের যন্ত্রণা এ বয়সেও দগ্ধ করে, একান্ত সাক্ষাৎকারে শীর্ষেন্দু

আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২৩, মঙ্গলবার

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। মায়ের ভাষা বাংলাকে রক্ষার জন্য আন্দোলন হয়েছিল। রক্তস্নাত হয়েছিল ঢাকার রাজপথ। জোর করে উর্দু চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। পশ্চিম পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা। এই দাবিতে শুরু হয়েছিল আন্দোলন। সেই আন্দোলন বুলেট দিয়ে দমানোর চেষ্টা করেছিল পাক সেনা। প্রাণ দিয়েছিলেন সালাম, রফিক, জব্বার, শফিউর-সহ বাংলা মায়ের বহু দামাল ছেলে। ভাষার জন্যও যে এভাবে অকাতরে প্রাণ দেওয়া যায়, তা প্রথম দেখেছিল তামাম দুনিয়া। ইউনেস্কোর স্বীকৃতির ফলে ১৯৯৯ সাল থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে সারাবিশ্বে।

 

২১শে ফেব্রুয়ারির প্রাক্-লগ্নে ‘পুবের কলম’-এর প্রতিনিধি অর্পিতা লাহিড়ীকে দেওয়া এক একান্ত সাক্ষাৎকারে বিশিষ্ট সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় জানালেন দেশভাগের যন্ত্রণা আজও তাঁকে দগ্ধ করে, আলাপচারিতায় উঠে এলো আরও নানা প্রসঙ্গ।

 

 

১৯৩৫ সালে অবিভক্ত বাংলার ময়মনসিংহে আপনার জন্ম, মাত্র ১১ বছর কাটিয়েছেন সেখানে। এরপর চলে আসা কলকাতায়। বাবার চাকরি সূত্রে কৈশোর এবং যৌবনের বড় অংশ অসমে কাটিয়েছেন। দেশভাগ দেখেছেন। সেই অনুভূতি যদি শেয়ার করেন।

 

শীর্ষেন্দু: দেখো, দেশভাগের যন্ত্রণা এই বয়সেও অনুভব করি। আমাদের কাছ থেকে দেশটা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। সেটা ভুলতে পারি না। ভিখিরিরও একটা তোবড়ানো অ্যালুমিনিয়ামের বাটি থাকে। যেটা তার একান্ত। নিজস্ব। সেটুকুও কেড়ে নেওয়া হলে তা দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। এই একই অবস্থা আমাদেরও হয়েছিল। যেটুকু ছিল, তাও কেড়ে নেওয়া হল। মতামতের তোয়াক্কা না করে। কিছু মানুষের সিদ্ধান্ত আমাদের ঘটিবাটিমাটি চাটি করে দিল। এটা আমাদের কাছে অসহনীয় লেগেছিল, আজও লাগে। তোমার অধিকার নেই। এটা কম অপমান নয়। এটা জনগণের মতামত নিয়ে তৈরি হয়েছিল বলে আমার মনে হয় না। কিছু নেতানেত্রী নিজেদের বাহবা কুড়োনোর জন্য দেশভাগের সব শর্ত মেনে নিয়েছিল। তারা চেয়েছিল নিজেদের কৃতিত্ব দেখাতে। সেই কৃতিত্বের অধিকারী তারা হল। তবে কোটি কোটি মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে। ভিটে হারানোর যন্ত্রণাটা যে কত মর্মান্তিক, তা ভিটে যে হারিয়েছে, সে ছাড়া আর কেউ বুঝবে না। আমরা বুঝি।

 

অসমেও বাংলা ভাষা আন্দোলন হয়েছিল ১৯৬১ সালের ১৯ মে। বাংলা ভাষা আন্দোলনে ১১ জন শহিদ হয়েছিলেন। শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে অসম পুলিশ বাংলাভাষীদের গুলি করে। পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষার জন্য যে আন্দোলন, তা মাতৃভাষা আন্দোলনের স্বীকৃতি পায়। কিন্তু ভারতের শিলচরে তাঁরা ভাষা শহিদ হলেন, সেই প্রাপ্য মর্যাদা তাঁরা পেলেন না কেন?

 

শীর্ষেন্দু: মর্যাদাটা আমরা দিইনি, কিন্তু দেওয়া উচিত। বিষয়টা হাইলাইটেড হয়নি। ওদের (অসমিয়া) একটা ভয় আছে। ওরা ভাষাগত দিক থেকে সংখ্যালঘু হয়ে যাচ্ছে। অসমে একটা বাঙালি বিদ্বেষ তৎকালেও ছিল। এখনও কতটা আছে আমি জানি না। যেহেতু পাকিস্তান থেকে লোক আসছে, সেটা ওদের কাছে আতঙ্কের হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিশেষ করে কাছার, সেটি ছিল বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চল। এটাকে তো অসম বলে মনেই হয় না, এটিকে তো আলাদা রাজ্য করে দেওয়া যেতই। ভাষা শহিদ কিন্তু প্রথম অসমেই হয়। এটাকে আমরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। বাংলাদেশ ভাষাভিত্তিক দেশ। তবে আমাদের আশা ছিল বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হবে, কিন্তু নিরপেক্ষ থাকল কোথায়? তবে বাংলা ভাষা ভিত্তিক দেশ হয়েছে, সেটা আমাদের কাছে খুব আনন্দের।

 

‘পার্থিব’ উপন্যাসে আপনি দেশভাগের ছবি একেছেন। বাসা ভাঙার কথা বলেছেন, যদি সাহিত্যিক না হতেন, বাংলা ভাষাকে যদি আঁকড়ে না ধরতেন, তাহলে কীভাবে এই কুরে কুরে খাওয়া দেশভাগের যন্ত্রণাটাকে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন?

 

শীর্ষেন্দু: দেখো, যার মাধ্যম আছে সে তার প্রকাশ করে। আমি যদি আজ না লিখতাম, তাহলে সেটা পারতাম না। বেদনা সবার মধ্যেই থাকে, কিন্তু সেটা সবাই প্রকাশ করতে পারে না।

 

আজকাল বাংলা ভাষায় হিন্দির অনুপ্রবেশ হচ্ছে, এটা কি বিপজ্জনক প্রবণতা?

শীর্ষেন্দু: দেখো, ভাষা একটা চিরপরিবর্তনশীল জিনিস। ভাষা পরিবর্তিত হবেই, অন্য ভাষার প্রভাবে ভাষার মধ্যে পরিবর্তন আসবেই, শধ ঢুকে যাবে, ভালো করে খেয়াল করে দেখলে দেখবে তুমি এখন ইংরিজি ভাষার মধ্যে প্রচুর বাংলা শব্দ পাবে। বারান্দা, পাজামা, ইংরেজি শধের মধ্যে শ্বশুর শাশুড়িও ঢুকে যাচ্ছে। একটা ভাষা একটা ভাষা থেকে ধার করে।

 

আপনার লেখার মধ্যে একটা আধাত্ম্যবাদের প্রভাব পাই, সেটা নিয়ে কী বলবেন।

শীর্ষেন্দু: আমি নিজে ওই পথে চলার চেষ্টা করি। আমার জীবনে গুরুর মস্তবড় প্রভাব আছে। আমি নিজে থেকে কিছু করি না। ওটা চলেই আসে।

 

শিশু-কিশোরদের মধ্যে কি বাংলা পড়ার প্রবণতা কমছে?

শীর্ষেন্দু: দেখো, রবীন্দ্রনাথ নিজের লেখা বইয়ের কপি ৫০০ ছাপার কথা বলছেন এক জায়গায়। আগেও বাঙালি পড়ত না, এখনও তার পড়ার অভ্যাস নেই। তবে এখন বইমেলার কল্যাণে পরিস্থিতি খানিকটা বদলেছে। প্রকাশকরা এখন বই প্রকাশের সৌজন্যে বিদেশ পর্যন্ত যাছেন।

অনেক ধন্যবাদ আমাদের এতটা সময় দেওয়ার জন্য।

শীর্ষেন্দু: ধন্যবাদ তোমাদেরও।