চিনের ঋণের জালে জর্জরিত শ্রীলঙ্কায় দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি

- আপডেট : ২৬ মার্চ ২০২২, শনিবার
- / 11
পুবের কলম প্রতিবেদক: ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর সবচেয়ে বড় আর্থিক সঙ্কটের সামনে শ্রীলঙ্কা। চিনের ঋণ জালে জর্জরিত হয়ে শ্বাসরুদ্ধ দেশের অর্থনীতির। দেশে দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য সাধারণের ধরাছোঁয়ার অনেকটাই বাইরে। চিনি ২৯০ টাকা এবং চাল ৫০০ টাকা কেজি। ৪০০ গ্রাম মিল্ক পাউডারের দাম ৭৯০ টাকা। অর্থনৈতিক বিপর্যয় একটি দেশকে কীভাবে চরম পরিস্থিতিতে নিয়ে যেতে পারে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ বর্তমান শ্রীলঙ্কা পরিস্থিতি। গণরোষ সামলাতে পেট্রোল পাম্পেও সেনা মোতায়েন করতে হয়েছে সরকারকে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে প্রয়োজনীয় জিনিস আমদানি করতে সরকারের হাতে কেবল ১৫ ডলার বাকি রয়েছে। মার্চ মাসে দেশে মাত্র ২.৩৬ বিলিয়ন ডলার অবশিষ্ট রয়েছে। পরিস্থিতি এতটাই সঙ্গীন সরকারের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ছাপার জন্য কাগজ-কালিটুকুও নেই।
ডিজেল-গ্যাসোলিন এবং গ্যাসের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আরও খারাপ। দু’সপ্তাহে পেট্রোলের দাম ৫০ টাকা এবং ডিজেল ৭৫ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে প্রতি লিটার পেট্রোল ও ডিজেলের দাম যথাক্রমে ২৫৪ টাকা এবং ১৭৬ টাকা। পাম্পগুলিতে কঠোর সেনা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে জ্বালানি মিললেও হাজার হাজার মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে। দেশের সরকার পেট্রোল ডিজেল আমদানি করার ক্ষমতাও হারিয়েছে। বর্তমানে শ্রীলঙ্কার ২০ শতাংশ পরিবার রান্না করতে প্যারাফিনের উপর নির্ভরশীল। তা সত্ত্বেও একজনের মালিকানা এখনও গড় ব্যক্তির নাগালের বাইরে। পেট্রোলিয়াম জেনারেল এমপ্লয়েজ ইউনিয়নের সভাপতি অশোক রানাওয়ালের মতে, শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে অপরিশোধিত তেলের ঘাটতির কারণে সরকারকে তাদের একমাত্র তৈল শোধনাগারটিও বন্ধ রাখতে হয়েছে। ১২.৫ কেজি রান্নার গ্যাস সিলিন্ডারের দাম ছিল ১৩৫৯ টাকা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪১১৯ টাকা।
শ্রীলঙ্কায় খাদ্য মুদ্রাস্ফিতী ২৫.৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। দুধ, পাউরুটির মতো অত্যাবশকীয় খাদ্যবস্তুর দামবৃদ্ধি এরই পরিণামস্বরুপ এমন পরিস্থিতিতে মুদ্রাস্ফিতীর আন্দাজ করা যায় সকালে এক কাপ চায়ের দামে। এক কাপ চায়ের দাম ১০০ টাকা। প্রতি কিলো চিনি ২৯০ টাকা, চাল ৫০০ টাকা কেজি এবং ৪০০ গ্রাম মিল্ক পাউডার ৭৯০ টাকা।
অনেক বিশেষজ্ঞদের মতে শ্রীলঙ্কার এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী চিনের কাছে তাঁদের ঋণজাল। শ্রীলঙ্কার কাছে চিনের ঋণ রয়েছে ৫ বিলিয়ন ডলার। শ্রীলঙ্কা ভারত এবং জাপানের কাছেও ঋণ নিয়েছে। শ্রীলঙ্কা ২০২১ সালে ফের চিনের থেকে ১ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেয়। শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপক্ষে সম্প্রতি চিনকে ঋণের শর্ত শিথীল করার অনুরোধ করলেও তা প্রত্যাখাত হয়েছে। চিনের বিপুল পরিমাণ সম্পদ হাতিয়ে নিয়েছেন শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি গোতাবায় রাজপক্ষে। চিনের হম্বান টোটা হারবারে তিনি বহু টাকা ব্যায় করেছেন।
আনুমানিক ২১.৯০ মিলিয়ন জনসংখ্যার শ্রীলঙ্কায় ২৫ শতাংশ অর্থনীতিই পর্যটন নির্ভরশীল। ২০১৯ সালে ধারাবাহিক বোমা বিস্ফোরণ এবং করোনার কারণে পর্যটন শিল্পে নাভিশ্বাস উঠেছে। শ্রীলঙ্কার জিডিপিতে পর্যটনের অংশ এখন ১৫ শতাংশ থেকে ৫-এ নেমে এসেছে। এদিকে বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতির কারণে কানাডা সহ অনেক দেশই শ্রীলঙ্কার ভ্রমণ না করার পরামর্শ দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে পর্যটন শিল্প ভয়াবহ ভাবে মার খেয়েছে শ্রীলঙ্কায়। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার আমদানি তলানিতে ঠেকেছে। এসব কমানোর কারণে আমদানিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এই সংকটবৃদ্ধির অন্যতম কারণ হল সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কমে যাওয়া। ২০১৯ সালে শ্রীলঙ্কায় যেখানে ১.৬ বিলিয়ন এফডিআই এসেছিল। যা ২০১৯ কমে ৭৯৩ মিলিয়ন ডলার হয়ে যায়– এবং আরও কমে ২০২০ তে নাটকীয় ভাবে ৫৪৮ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছয়।
গোতাবায় রাজপক্ষে শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরই বিদেশি মুদ্রা শেয়ারে উল্লেখযোগ্য পতন শুরু হয়েছে। ২০১৯-এ গোতাবায় ক্ষমতাসীন হওয়ার সময় শ্রীলঙ্কার কাছে ৭.৫ বিলিয়ন ডলার বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার ছিল এবং ২০২১ এর জুলাইয়ে তা ২.৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। এর সরাসরি কারণ শ্রীলঙ্কায় বিদেশি মুদ্রার ঘাটতি। ফলে, সরকারের কাছে নিত্যপ্রয়োজনীয় বস্তু, অর্থাৎ আমদানির জন্য অর্থ নেই এবং ইন্ধন, ডিজেল এবং খাদ্যবস্তুর হাহাকার দেখা দিয়েছে। যে কারণেই খাদ্যবস্তু থেকে জ্বালানি, পেট্রোপণ্যের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে শ্রীলঙ্কার আম-আদমীর ওপর। শ্রীলঙ্কা এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে ভারত এবং চিনের সাহায্য প্রার্থনা করেছে। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কাকে ২.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার কথা ভাবছে চিন। ভারতও শ্রীলঙ্কাকে আশ্বাস দিয়েছে নেইবারহুড ফার্স্ট নীতির পালন করবে এবং পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে শ্রীলঙ্কাকে সাহায্য করবে।