সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা: ভারত-বাংলাদেশের কূটনৈতিক যুদ্ধ

- আপডেট : ২০ এপ্রিল ২০২৫, রবিবার
- / 32
বিশেষ প্রতিবেদকঃ ইতিমধ্যে দুই দেশের সংখ্যালঘুদের রক্ষা করার প্রশ্নে পরস্পরকে বিদ্ধ করায় ভারত ও বাংলাদেশ উভয় রাষ্ট্রই কড়া অবস্থান নিয়েছে। দুই দেশ সরকারিভাবে পরস্পরকে যে বার্তা দিয়েছে, তাও বেশ কঠোর। বিষয়টির শুরু মুর্শিদাবাদের ঘটনায় বাংলাদেশ জড়িত রয়েছে বলে ভারতের সাংবাদমাধ্যমে যে খবর দেখা যায় তা থেকে। নেতাজি ইন্ডোরে ইমাম-মুয়াজ্জিনদের যে সম্মেলন হয়, তাতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সংবাদ-সংস্থা এএনআই-তে প্রচারিত একটি ট্যুইটের উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, সীমান্ত রক্ষার এবং পাহারাদারি করার দায়িত্ব বিএসএফ-এর।
যদি সত্যিই মুর্শিদাবাদের অশান্তিতে বাংলাদেশিদের হাত থাকে, তাহলে তার দায়ভার নিতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারকে। এরপরই বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, বাংলাদেশ কোনওভাবেই মুর্শিদাবাদের ঘটনায় জড়িত নয়। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ চায় ভারত এবং পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু মুসলিমদের সুরক্ষা প্রদান করুক। এই মন্তব্য দু’দেশের সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটায়। কারণ, এর আগে নয়াদিল্লি এবং ভারতীয় মিডিয়া বলে আসছিল, সংখ্যালঘুদের উপর বাংলাদেশে ব্যাপক নির্যাতন হচ্ছে। বেশ কিছুদিন এই প্রচার তুঙ্গে ছিল। তবে বাংলাদেশ সরকার তখনই বলেছিল, শেখ হাসিনা চলে যাওয়ার পর বাংলাদেশে আওয়ামি নেতা ও কর্মীদের উপর অত্যাচার ও আক্রমণ হয়েছে। আর তাতে মুসলিম ও হিন্দু উভয়ই রয়েছে। কিন্তু তারপর থেকে শুধুমাত্র ‘হিন্দু ’ বলে কারও উপর আক্রমণ হয়নি।
♦ আমরা একত্রে বাঁচব, লড়ব এবং জিতব: মমতা
কিন্তু বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিমদের সুরক্ষার দাবিতে নয়াদিল্লি বিশেষভাবে ত্রুদ্ধ হয়েছে। এর আগে বাংলাদেশ সরকার কখনই এভাবে পশ্চিমবঙ্গ, অসম ও ভারতের অন্যান্য প্রদেশে সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দেওয়ার দাবি তোলার সাহস পায়নি। তবে শেখ হাসিনা একবার বলেছিলেন, ভারতেরও দেখা উচিত যেন এমন কোনও ঘটনা না ঘটে, বাংলাদেশের উপর যার প্রভাব পড়বে। কিন্তু ইউনূস সাহেবের প্রেস সচিবের বক্তব্য ভারত মোটেই ভালোভাবে নেয়নি।
নয়াদিল্লি এক বিবৃতি দিয়ে বলেছে, ভারতের মুসলিমদের সম্পর্কে অযৌক্তিক ও গোপণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মন্তব্য না করে বাংলাদেশের বরং নিজেদের সংখ্যালঘুদের (হিন্দু ) রক্ষায় আরও মনযোগ দেওয়া উচিত। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের জন্য দায়ীরা মুক্তভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে বলেও উল্লেখ করেছেন বিদেশ দফতরের মুখপাত্র রণবীর জয়সওয়াল।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে প্রায় ১ কোটি ৪০ লক্ষ অমুসলিম রয়েছে। আর ভারতে মুসলিমদের সংখ্যা ২৫ কোটির মতো বলে জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য। পার্লামেন্টে তৎকালীন মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি বলেছিলেন, ২০২২ সালে দেশে মুসলিমদের সংখ্যা ২০ কোটির উপর। আর পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘুদের জনসংখ্যা সাড়ে ৩ কোটি। ফলে সংখ্যালঘুদের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভারত ভাগের পর নেহরু লিয়াকত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল পরস্পরের দেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার উপর নজর রাখার জন্য। নয়াদিল্লি সেই অনুযায়ী পাকিস্তাননের কাছে বিভিন্ন সময়ে বেশ কয়েকবার হিন্দু দের নিরাপত্তার ঘাটতি রয়েছে বলে অভিযোগ করেছে।
পাকিস্তানও ভারতের বিভিন্ন দাঙ্গার সময় একই অভিযোগ করেছে। এতে অবশ্য দুই দেশের সংখ্যালঘুদের অবস্থার তেমন কোনও হেরফের হয়নি। বাংলাদেশ কিন্তু কখনই এই স্পর্শকাতর বিষয়ে ভারতের দিকে আঙুল তোলেনি। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সম্ভবত এই প্রথম বাংলাদেশ সরকারিভাবে সংখ্যালঘু সুরক্ষা নিয়ে ভারত ও পশ্চিমবঙ্গকে বিদ্ধ করল। ভারতও জবাব দিয়ে বলেছে, বাংলাদেশের উচিত আগে নিজের ঘরের দিকে নজর দেওয়া।
এর মধ্যে একটি নতুন বিষয় যুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশের দিনাজপুরে বিরাল উপজেলার একজন হিন্দু নিহত হয়েছে। তাঁর নাম ভবেশ চন্দ্র রায় (৫৮)। তাঁকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে অর্ধমৃত অবস্থায় তাঁকে ফেরত দেওয়া হয়। পরিবার-পরিজনরা হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। ভবেশ চন্দ্র রায়কে কারা হত্যা করেছে? কেন করেছে? তার কোনও তদন্ত রিপোর্ট এখনও পাওয়া যায়নি। দু’টি বাইকে করে এসে অপহরণকারীরা তাঁকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। ভবেশ চন্দ্র রায় আওয়ামি লিগ বা কোনও হিন্দু সংগঠনের নেতৃত্ব পদে ছিলেন না। তবে তিনি তাঁর গ্রামের পুজা কমিটির সহ-সভাপতি ছিলেন। তবে মিডিয়া তাঁকে ওই এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা বলে অভিহিত করেছে।
ভারত সরকারও ভবেশ চন্দ্র রায়ের হত্যাকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছে। বিদেশ দফতর বলেছে, ভবশে চন্দ্র রায়ের হত্যাকান্ড হিন্দু সংখ্যালঘুদের উপর সিস্টেমেটিক নির্যাতনের নজিরমাত্র। এর অপরাধীরা কখনই শাস্তি পায় না। বিদেশ দফতর আরও বলেছে, অন্তর্বর্তী সরকারকে আমরা বলব, আপনারা সংখ্যালঘু ও হিন্দু দের রক্ষা করার দায়িত্ব পালন করবেন। এর জন্য কোনও অজুহাত খুঁজবেন না।
ভারতের কংগ্রেস দলও এই ঘটনার নিন্দা করেছে। জয়রাম রমেশ এবং খাড়গে কড়া ভাষায় এই ঘটনার প্রতিবাদ করে মোদি সরকারকে হিন্দুদের রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা নিতে বলেছে। বাংলাদেশে ও ভারতে যে সংখ্যালঘু নির্যাতন চলছে, তা এখন আর গোপন নয়। কিন্তু নয়াদিল্লি বরাবরই এই অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছে। দেখা গেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মীয় স্বাধীনতার সংক্রান্ত সংস্থা বা মার্কিন সরকারের কোনও বিভাগ যদি ভারতের মুসলিম ও খ্রিস্টানদের অধিকার ক্ষুণ্ণ করার উপর কোনও বিবরণ বা বক্তব্য দিয়েছে, ভারত কঠোর ভাষায় তা প্রত্যাখ্যান করেছে।
বলেছে, ওই ঘটনাগুলিকে সংখ্যালঘু নির্যাতন বলে বর্ণনা করা যায় না। ভারতে সংখ্যালঘু মুসলিম ও খ্রিস্টানরা বহালতবিয়তে রয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ওআইসি-র রিপোর্টকেও ভারত প্রত্যাখ্যান করে নিজ চরকায় তেল দিতে বলেছে। কাজেই বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্যকে ভারত নিজের ধর্মনিরপেক্ষতার ঐতিহ্য অনুযায়ী প্রত্যাখ্যান করেছে। ভারতে বিলকিস বানু বা গ্রাহাম স্টেইনস-এর ধর্ষণ ও হত্যাকারীদের মুক্তি দিয়ে রাজকীয় সংবর্ধনা দেওয়ার ঘটনা ঘটে। গো-রক্ষকরা অবাধে সন্দেহের বশে মুসলিম হত্যা করে। শত শত বছরের মসজিদ, মাদ্রাসা সরকারই বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেয়। এসব ঘটনাকে ভারত বিরাট দেশে স্বাভাবিক ঘটনা বলে মনে করে।
কিন্তু ভারতে সংখ্যালঘুদের উপর কিছু ঘটার অর্থ এই নয় যে, বাংলাদেশে হিন্দু দের উপর অত্যাচার হবে। ইউনূস সরকারকে অবশ্যই বাংলাদেশের ১ কোটি ৪০ লক্ষ অমুসলিমের নিরাপত্তার গ্যারেন্টি দিতে হবে। তা না হলে এই সরকারকে মানুষ অবশ্যই বর্ণবাদী ও সাম্প্রদায়িক সরকার বলে অবশ্যই অভিহিত করবে।