চক্রব্যূহের নজরদারিতে বন্দি ভারত! প্রযুক্তির জাঁতাকলে আটকে দেশের জনজীবন

- আপডেট : ২১ মার্চ ২০২৩, মঙ্গলবার
- / 15
বিশেষ প্রতিনিধি: প্রযুক্তির নৌকায় পা রেখে এগিয়ে চলেছে আধুনিক সভ্যতা। পড়াশোনা থেকে শুরু করে অপরাধ জগতের রহস্য উন্মোচনে মানুষ ডিজিটালের উপর নির্ভরশীল। অপরাধীদের খুঁজে বের করতে তদন্তকারি আধিকারিকদের কাছে অন্যতম ভরসার মাধ্যম সিসিটিভি ফুটেজ। আর সেই ফুটেজের মাধ্যমেই বৃহত্তর জনসংখ্যার উপর নজরদারি চালাচ্ছে ভারত। মানুষের সমস্ত কিছু সেই ডিজিটালের মধ্যে বন্দি।
সূত্র বলেছে যে, শাসন ব্যবস্থার উন্নতি এবং নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য একটি পুলিশের অধীনে থাকা দেশ প্রয়োজন। অপরদিকে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরাধের সঙ্গে খুব কম সম্পর্ক রয়েছে সেখানে গোপনীয়তা লঙ্ঘন করে দুর্বল ব্যক্তিদের লক্ষ্য করা হচ্ছে। অনেক সময়, সিসিটিভি ফুটেজের মাধ্যমে সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। তার পর পুলিশি হেফাজতে থেকে চলছে জিজ্ঞাসাবাদ। পরে দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদের পরে তার যখন মুক্তি মিলছে, তখন সেই ব্যক্তি হয়তো মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।
নজরদারিতে শুধু যে সিসিটিভি ভরসা ঠিক তা নয়, কারণ আধার কার্ডের সঙ্গে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের লিঙ্কড, যানবাহন রেজিস্ট্রেশন, সিম কার্ড, প্যান, ভোটার তালিকা সমস্ত কিছুর মাধ্যমেই নাগরিকদের ওপর সরকারি এজেন্সিগুলি তাদের কড়া নজর রেখেছে।
‘সিসিটিভি ফুটেজের ভরসার’ নজরদারিতে চলা এক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে হায়দরাবাদে। যেখানে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে এই সিসিটিভি ফুটেজ দেখেই কাদের খান বলে এক যুবককে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশের দাবি ছিল, কাদের ছিনতাইয়ের ঘটনা সঙ্গে যুক্ত। কয়েকদিন পর কাদেরের মুক্তি মেলে। সেই সময় তার সারা শরীরের আঘাতের চিহ্ন ছিল, চিকিৎসা চলাকালীন মৃত্যু হয়। পুলিশের যুক্তি, কাদের খানকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, সিসিটিভি ফুটেজে দেখেই। কারণ অভিযুক্তের সঙ্গে তার চেহারার মিল খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল।
পরে জানা যায়, এই কাদের খান অভিযুক্ত সেই ব্যক্তি নন, তখন তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। এই ঘটনায় পুলিশ সুপার সাইদুল্লা বলেন, সব কিছু আইনি প্রক্রিয়া মেনেই হয়েছে।
৩৬ বছর বয়সী যুবক কাদের খানের এই ঘটনায় সরব হয় মানবধিকার কর্মীরা। সমাজকর্মী মাসুদের বক্তব্য, সিসিটিভি ফুটেজের সর্বাধিক ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এটি একটি ক্রমবর্ধমান ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ সিসিটিভি ফুটেজ, মুখ দেখে অপরাধীকে শনাক্ত করার প্রক্রিয়া অনেক সময় তদন্তকে ভুল পথে চালিত করে। ২০২১ সালে তেলেঙ্গানায় মুখ দেখে শনাক্ত করে একটি মামলা দায়ের হয়। যেটি এখনও চলছে।
মাসুদ ‘থমাস রির্টান্স ফাউন্ডেশন’কে জানিয়েছেন, এই নজরদারি সমাজের জন্য খুব ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। দেশজুড়ে, স্কুল, বিমানবন্দর, ট্রেন, স্টেশন, কারাগার এবং রাস্তায় সিসিটিভি এবং মুখের শনাক্তকরণের ব্যবহার বাড়ছে। কারণ কর্তৃপক্ষ অপরাধ দমন এবং নিখোঁজ শিশুদের শনাক্ত করার জন্য একটি দেশব্যাপী ব্যবস্থা চালু করেছে। তবে এটি একমাত্র নজরদারির পথ নয়। রয়েছে আধার কার্ড, যানবাহন রেজিস্ট্রেশন, প্যান কার্ড প্রভৃতি।
দিল্লির একটি অ্যাডভোকেসি গ্রুপ, ইন্টারনেট ফ্রিডম ফাউন্ডেশনের আইনি পরামর্শদাতা আনুষ্কা জৈন বলেন, সব কিছুই ডিজিটাইজ করা হচ্ছে। তাই একজন ব্যক্তির সম্পর্কে প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করা যা সরকার এবং ব্যক্তিগত সংস্থাগুলির কাছে পর্যাপ্ত সুরক্ষা ছাড়াই অ্যাক্সেসযোগ্য। এমন সময়ে যখন মানুষের ধর্ম, ভাষা এবং লিঙ্গ দেখে যদি শনাক্তকরণের কাজ চলতে থাকে, তাহলে এই ধরনের ব্যবস্থা খুবই ক্ষতিকারক। কারণ এই সন্দেহে তালিকায় এই ধরনের মানুষগুলি থাকবে, যারা কোনও প্রতিবাদ করতে পারবে না, নিজেদের সমস্ত অধিকার হারাবে, এমনকি সরকারি সমস্ত প্রকল্প থেকে তারা বঞ্চিত হবে।
রাষ্ট্রসংঘের অনুমান অনুসারে, এপ্রিল মাসে ১৪৩ কোটি বেশি জনসংখ্যায় পৌঁছবে ভারত। চিনকে ছাড়িয়ে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশে পরিণত হতে চলেছে ভারত।
মোদি সরকার ভারতে কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ডিজিটাল ইন্ডিয়া কর্মসূচিকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। জমির শিরোনাম থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য রেকর্ড, টাকা-পয়সা লেনদেন পর্যন্ত সব কিছুই ডিজিটাইজ করে দেওয়া হচ্ছে।
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, দেশের মানুষ এখন ইউপিআই-এর ভক্ত হয়ে গেছেন। আধার এখন গোটা বিশ্বের কাছে বায়োমেট্রিক ডাটাবেস।
তবে ২০১৪ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায় ছিল যে কল্যাণমূলক কর্মসূচীর জন্য আধার কার্ড প্রয়োজনীয় নথি নাও হতে পারে, এই তথ্য পেনশন এবং কর্মসংস্থান প্রকল্পগুলির জন্য বাধ্যতামূলক৷ কিন্তু তাও অনেক সময় ভুল বিবরণ ও আঙুলের ছাপ না মেলার কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষ পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হয়।
কেন্দ্রের মোদি সরকারের দাবি আধারের সঙ্গে লিঙ্ক দেশে সুশাসন নিয়ে আসবে। কিন্তু অন্যদিকে দেখতে গেলে দেশবাসীর জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সব নথি সরকারের কাছে আছে।
জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান গ্যারান্টি স্কিমের অধীনে ন্যাশনাল মনিটারিং মোবাইল সফটওয়্যার অ্যাপটি চালু করা হয়। এই নয়া সিস্টেমে একজন শ্রমিককে কাজ শুরু ও শেষ করার আগে উপস্থিতির প্রমাণ দিয়ে ছবি আপলোড করতে হয়। কিন্তু অনেক সময় ইন্টারনেটের স্থিতিশীলতা, ছবি তোলার ক্ষেত্রে বিশেষত মহিলাদের দ্বিধা গ্রামীণ এলাকাগুলতিতে অন্যতম সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। আর ছবি না আপলোড করতে পারলে, কাজে তাদের অনুপস্থিতি ধরা হয়, সেক্ষেত্রে বেতন পাবে না তারা।
সম্প্রতি জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান গ্যারান্টি স্কিমের অধীনে কর্মীরা তাদের প্রাপ্য বেতনের দাবিতে বিক্ষোভ দেখায়। গ্রামীণ উন্নয়ন মন্ত্রকের আশ্বাস অ্যাপটিকে আরও উন্নত করা হবে, যাতে কর্মীদের আর কোনও অভিযোগ থাকবে না।