Murshidabad: অশান্তি বাধানোর চেষ্টা কাদের, কারা লাভবান হবে?

- আপডেট : ১৪ এপ্রিল ২০২৫, সোমবার
- / 72
এ হাসান: যাদের লক্ষ্য শুধুমাত্র ভোট-রাজনীতি, সেইসব রাজনৈতিক দলকে ভোট হাসিলের জন্য অনেক কিছু করতে হয়। ভোটের সময় ছড়াতে হয় তীব্র ধর্ম-বিদ্বেষ, জাতি-বিদ্বেষ ইত্যাদি অনেক কিছু। দেখা যায়, দেশের সর্বোচ্চ পদে আসীন ব্যক্তি সমানে মিথ্যা বলছেন, ভুয়ো তথ্য দিচ্ছেন, দিচ্ছেন জাতি-দাঙ্গার প্ররোচনা। লক্ষ্য একটাই, ভোটে বিজয় হাসিল করবেন। তাই আমরা দেখতে পাই, বলা হচ্ছে সতী-সাধ্বী নারীর গলা থেকে মঙ্গলসূত্র ছিনিয়ে নেবে, বলা হচ্ছে ঘুষপেটিয়ারা লাভজিহাদ করছে, আমাদের মেয়েদের বিয়ে করছে, আমাদের গরু-মহিষ ছিনিয়ে নেবে ইত্যাদি সম্ভব-অসম্ভব কত কথা। এই ধরনের নির্বাচনী প্রচার ভারতবর্ষে কল্পনা করা যেত না। এমনকি কোনও এক বিশেষ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে যদি এই ধরনের প্রচার পাকিস্তান বা বাংলাদেশে চালানো হয়, তারও কঠোর নিন্দা বিশ্বজুড়ে হওয়া উচিত। কিন্তু পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে তাই হচ্ছে। আর এই ধরনের বিদ্বেষ প্রচারের বিরুদ্ধে না নির্বাচন কমিশন, না পুলিশ-প্রশাসন, না আদালত কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। ব্যতিক্রম ছিল কয়েকটি প্রদেশ। তার মধ্যে অগ্রণী হচ্ছে আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ। কিন্তু সেখানেও এখন সমস্ত ধরনের শালীনতা ও সংযম বর্জিত প্রচার চালানো হচ্ছে। গোটা রাজ্যে শুধু বিদ্বেষের বীজ পোঁতা নয়, সমগ্র পশ্চিমবঙ্গকে অস্থির-অশান্ত করে তোলার প্রচেষ্টা করা হচ্ছে।
রবিবারের কথাই ধরা যেতে পারে। বিজেপি সুপ্রিম রায়ে শিক্ষকদের চাকরি-চ্যুতি এবং মুর্শিদাবাদে (Murshidabad) অশান্তি নিয়ে একটি মিছিল বের করে। মিছিলটি কলেজ স্কোয়ার থেকে যাত্রা শুরু করে রাণী রাসমনী রোড পর্যন্ত যায়। এই মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন শুভেন্দু অধিকারি, দিলীপ ঘোষ, সুকান্ত মজুমদার প্রমুখ। বিজেপি একটি স্বীকৃত রাজনৈতিক দল হিসেবে অবশ্যই মিছিল করবে, প্রতিবাদ কিংবা সমর্থন জানাবে। কিন্তু মিছিলের ব্যানারে যে শ্লোগানটি লেখা রয়েছে, তাহল ‘চাকরি চোর ও হিন্দু হত্যাকারী মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ চাই’। মুর্শিদাবাদে যে অশান্তি হয়েছে, তা সর্বতোভাবে নিন্দনীয় ও প্রতিবাদযোগ্য। কিন্তু এর জন্য কি মুখ্যমন্ত্রী দায়ী? গুজরাতে ২০০২-২০০৩ সালে যে ভয়াবহ দাঙ্গা হয়, তখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নরেন্দ্র মোদি কিন্তু শুভেন্দু বাবুরা এখন অর্থাৎ তিনি বিজেপি হওয়ার পর একবারও নরেন্দ্র মোদিকে দায়ী করেন না। যদিও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে মোদিজি বলেছিলেন, যদি কুকুরের ছানা গাড়ির চাকায় পিষে যায় তাহলে যেমন দুঃখ হয় তেমনি দুঃখ গুজরাত দাঙ্গায় প্রাণহানীর জন্য আমার হয়েছে।
আরও পড়ুন: Waqf Law: ইমাম-মুয়াজ্জিন ও বুদ্ধিজীবীদের সাংবাদিক সম্মেলন
গুজরাত দাঙ্গায় মুসলিমদের বাড়িঘর-সম্পত্তি ও নরহত্যা পুলিশের উপস্থিতিতে বা সহায়তায় হয়েছে। কিন্তু ‘কুত্তাকে পিল্লের’ জন্য দুঃখের কথা বলে মোদি সব দায়িত্ব ঝেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু মুর্শিদাবাদের জন্য শুভেন্দু বাবুরা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দায়ী করছেন। এইসব না করলে হয়তো বা শুভেন্দু বাবুদের বিজেপি বাংলার গদি দখল করতে পারবে না। আর তাই বলতে হবে, মমতা ‘ হিন্দু হত্যাকারী’।
মুর্শিদাবাদে (Murshidabad) যে অশান্তি হয়েছে, তা কে করেছে, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠছে। কিন্তু মুর্শিদাবাদে শুধু হিন্দুরাই আক্রান্ত হননি, মুসলিমরাও হয়েছেন। একজন মুসলিম যুবক মারা গিয়েছে, কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়েছে। একপক্ষের যেমন ঘরবাড়ি, দোকানপাট ধুলিয়ানে ভাঙচুর হয়েছে, প্রতিশোধস্বরূপ অন্যপক্ষেরও তা হয়েছে। তাই একপক্ষ যদি বলে মুসলিম হত্যাকারীদের বিচার চাই, আর অন্যপক্ষও বলে হিন্দু হত্যাকারীদের বিচার চাই, তা খুবই অন্যায় ও একপেশে প্রচার। যা হওয়া প্রয়োজন তা হচ্ছে যারা প্রকৃত হত্যাকারী, অশান্তিকারী তাদের প্রত্যেকের বিচার চাই। কিন্তু প্রকৃত দোষীদের বিচার শুভেন্দু বাবুদের কাম্য নয়। তাঁরা চান, বাংলায় তাঁদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল।
এ প্রসঙ্গে আর একটি কথাও বলে দেওয়া প্রয়োজন। বর্তমানে বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারি হাইকোর্টে গিয়ে খুবই ভালো কাজ করেছেন। তিনি মুর্শিদাবাদে (Murshidabad) কেন্দ্রীয় বাহিনী নামানোর জন্য হাইকোর্টের আদেশ নিয়েছেন। খুবই ভালো কথা। অবশ্য স্থানীয় প্রশাসন আগেই বিএসএফ-এর সাহায্য নিয়েছিল। কিন্তু শুভেন্দু বাবুর হাইকোর্টে যাওয়া অভিনন্দনযোগ্য।
এই মডেলটি ভবিষ্যতেও সকলের মনে রাখা প্রয়োজন। কারণ, গুজরাতে কুখ্যাত ভয়াবহ দাঙ্গা থামানোর জন্য যদি সেনাবাহিনী নামানো হত, তাহলে কিন্তু এত প্রাণহানী এবং সম্পত্তি ধ্বংস হত না। আর সারা বিশ্বে আমাদের দেশের এত বদনামও হত না। প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ীর সেনা নামানোর ইচ্ছা ছিল। ছিল তৎকালীন রাষ্ট্রপতিরও। আর কেন্দ্রের নির্দেশে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জমিরউদ্দীন শাহ সেনাবাহিনীকে নিয়ে ব্যারাকে অপেক্ষাও করছিলেন যে তারা দাঙ্গা থামানোর কাজে নামবেন।
শুধু আদেশের অপেক্ষা। কিন্তু মোদি সাহেবের প্রশাসন থেকে কখনই সেই আদেশ সেনাবাহিনীকে দেওয়া হয়নি। লেফটেন্যান্ট জেনারেল জমিরউদ্দীন শাহ তাঁর আত্মজীবনী ‘সরকারি মুসলিম’ গ্রন্থে বলেছেন, আমরা চোখের সামনে দেখছিলাম অগ্নিসংযোগ, বোমা বিস্ফোরণ হচ্ছে। সেনাবাহিনী একটু চেষ্টা করলেই তা থেমে যেত। আমরা কিন্তু আর্ত মানুষের সহায়তা করার আদেশ পাইনি।
আরও পড়ুন: গুজব ছড়ানো নিয়ে হুঁশিয়ারি ADG আইনশৃঙ্খলার, দোষীদের পাতাল থেকে বের করে শাস্তির নিদান
কলকাতা হাইকোর্টকে ধন্যবাদ দিতে হবে বিজেপি নেতা শুভেন্দু বাবুর অনুরোধে সারা দিয়ে তারা সরাসরি মুর্শিদাবাদে (Murshidabad) অশান্তি রোখার জন্য কেন্দ্রীয় বাহিনী নামিয়ে দিয়েছে। এই ধরনের নজির সবসময় উদ্ধৃত করার যোগ্য। তা সে উত্তরপ্রদেশ হোক কিংবা গুজরাত, মণিপুর কিংবা আমাদের বাংলা সব জায়গাতেই প্রযোজ্য হওয়া প্রয়োজন। যারা ওয়াকফ বিলটি জবরদস্তি ভারতের ২৫ কোটি মুসলিমের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন, তারা হয়তো এমনটাই কল্পনা করেছিলেন। কারণ, ওয়াকফ সম্পত্তিতে সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আসবে তা ভারতের মুসলিমদের যারা ওয়াকফ করেছিলেন, তারা কেউই চাননি।
কেউই বলেননি এমন ধরনের একটা আইন ওয়াকফের জন্য আমাদের প্রয়োজন। ওয়াকফ সম্পত্তি আল্লাহর উদ্দেশে দেওয়া হয়। তা দেওয়া হয় যিনি ওয়াকফ করেছেন তার ইচ্ছে অনুযায়ী কয়েকটি খাতে। সেগুলি হচ্ছে ধর্মীয় কাজকর্ম, গরিব মানুষের সহায়তা, মসজিদ- মাদ্রাসা -কবরস্থান পরিচালনা ইত্যাদি কাজে ব্যবহার করার জন্য। আর ভারতের সংবিধানে নাগরিকদের এবং বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়কে যে মৌলিক অধিকার দেওয়া হয়েছে, নয়া ওয়াকফ আইন তা ছিনিয়ে নিয়েছে। ভারতের পার্লামেন্টে কিংবা ভারতের বিধানসভাগুলিতে একজনও মুসলিম জনপ্রতিনিধি মোদিজির ওয়াকফ আইনের পক্ষে কথা বলেননি। বলেছেন তাঁর বিপরীতে। আর সবথেকে বেশি বলেছেন পার্লামেন্টে দক্ষ সংবিধান ও আইন বিশেষজ্ঞ সাংসদরা। কিন্তু কারও কোনও আপত্তি না শুনে সামান্য গরিষ্ঠতার জোরে মোদি সরকার তাদের গোপন উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এই আইনটি চাপিয়ে দিয়েছেন। তার প্রতিক্রিয়া আমরা দেখতে পাচ্ছি। কিভাবে তা দেশে অশান্তি ও ক্ষোভ তৈরি করছে।
মুর্শিদাবাদেও (Murshidabad) যে আন্দোলন হচ্ছিল তা ছিল সাধারণ মানুষের ওয়াকফ বিরোধী আন্দোলন । এর সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতা কিংবা হিন্দু বিরোধিতার কোনও সম্পর্ক নেই। কিন্তু কিছু মানুষ চাইছিলেন এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দাঙ্গা পরিস্থিতি সৃষ্টি করার। তারা সেটা করতে পেরেছেন। আর এক শ্রেণির মিডিয়াকে ব্যবহার করে এক পেশে খবর দেখানো হচ্ছে। যেমন শুধুমাত্র হিন্দু পক্ষের যে ঘরবাড়ি নষ্ট হয়েছে বা যে মা-বোনেরা করুণ বক্তব্য দিচ্ছেন, তা প্রচার করা হচ্ছে। কিন্তু মুসলিমরাও যে আক্রান্ত হয়েছেন, তাদেরও যে ঘরবাড়ি, দোকানপাট বিনষ্ট হয়েছে বা তাদের আহত, নিহতদের আত্মীয়-স্বজনের করুণ শোকার্ত বক্তব্য কিন্তু মিডিয়া এড়িয়ে যাচ্ছে। ফলে বাংলা এবং ভারতে একটি বিশেষ এক একপেশে বৃত্তান্ত উঠে আসছে।
মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম যিনি হিন্দু -মুসলিম সকল সম্প্রদায়ের মধ্যেই জনপ্রিয় এবং তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ বলেছেন, মুর্শিদাবাদে (Murshidabad) যে অশান্তি হয়েছে, তার পিছনে কাদের মদদ রয়েছে তা তদন্ত করে সামনে আনতে হবে। কুণাল ঘোষ বলছেন, বিএসএফ যা কেন্দ্রের হাতে রয়েছে তাদের মাধ্যমেই হামলাকারীদের মদদ দিয়ে বাংলায় অশান্তির চেষ্টা করা হচ্ছে। যারা গন্ডগোল করেছে তাদের পান্ডাদের স্থানীয় মানুষরা চিনতে পারছে না। তিনি আরও বলেছেন, এদেরকে গন্ডগোল করে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। ফিরহাদ হাকিম বলেছেন, আক্রান্তদের মধ্যে মুসলিমরাও রয়েছেন। তাঁর মতে, রাজনীতির ফায়দা নেওয়ার জন্যই এমনটা করা হয়েছে। সাধারণ হিন্দু -মুসলিম অশান্তি করেননি। অন্যদিকে জঙ্গিপুরের সাংসদ খলিলুর রহমানও বলেছেন, কারা দক্ষতার সঙ্গে এই অশান্তি করেছে তা তদন্ত করে দেখার জন্য তিনি পুলিশ-প্রশাসনকে অনুরোধ করেছেন। তিনি বিধায়কদের নিয়ে শান্তি মিছিল করেন। আর সকলকে তিনি আশ্বস্ত করেছেন। এখন প্রয়োজন পশ্চিমবঙ্গে যাতে কোনও মহল পরিস্থিতি খারাপ করার জন্য ইন্ধন দিতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখা এবং সকলে মিলে পশ্চিমবঙ্গে শান্তি ও সৌহাদ্র পরিবেশ যাতে যে কোনও মূল্যে বজায় থাকে তার জন্য শপথ নেওয়া।