১৮ এপ্রিল ২০২৫, শুক্রবার, ৪ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

গাজায় রমযান: ধ্বংসস্তূপের মাঝে ঈমানি শক্তিতে অবিচল ফিলিস্তিনবাসী

সুস্মিতা
  • আপডেট : ২ মার্চ ২০২৫, রবিবার
  • / 10

ধ্বংসস্তূপের মাঝে সদ্য পরিষ্কার করা রাস্তায় লম্বা টেবিল ফেলা হয়েছে। যেখানে আযানের অপেক্ষা করছেন গাজার রোযাদাররা।

গাজা: শুরু হয়েছে পবিত্র রমযান। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মুসলমানদের মতো ইসরাইলি আগ্রাসনে বিধ্বস্ত গাজার মানুষেরাও শুরু করেছেন রোযা। তবে অন্যান্য দেশ বা অঞ্চলের মানুষ যতটা উৎসাহ, উদ্দীপনা আর উচ্ছ্বাস নিয়ে রমযান শুরু করেছেন, শোকাহত গাজাবাসীর সেই সুযোগ ছিল না। কিন্তু তাদের বিশ্বাসের কোনো কমতি নেই। যুদ্ধের আর্তনাদ এখনো কানে বাজছে। এই যুদ্ধবিরতি স্থায়ী হবে কি না, কেউ জানে না। সবাই উদ্বিগ্ন ভবিষ্যৎ নিয়ে। সবারই আশঙ্কা, যদি আবার যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়!
কিন্তু গত বছরের রমযান ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেটা ছিল অকল্পনীয়ভাবে ভয়াবহ। চারপাশে শুধুই ক্ষুধা। সারা দিন উপবাস। বিদ্যুৎ না থাকায় বিস্বাদ টিনজাত খাবার অন্ধকারে চিবিয়ে খেতে হত। গাজাবাসীর কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল রমযানের আনন্দময় আবহ। তারা ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষা করত মাগরিবের আযানের জন্য, ফজরের আযানের জন্য; কিন্তু সেই ডাক কখনো শোনা যেত না। সব মসজিদ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। যারা আযান দিতে চেয়েছিল, তারাও ভয় পেয়েছিল। ভয় ছিল, তাদের কণ্ঠস্বর হয়তো বোমার নিশানা বানিয়ে দেবে, তারা হয়তো হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে। কাছের মসজিদের লাউডস্পিকারে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠ শোনার বদলে ইফতার করত ক্ষেপণাস্ত্রের বিকট আওয়াজ আর গোলাগুলির শধে। গাজার সবচেয়ে সুন্দর ও ঐতিহাসিক মসজিদগুলোর একটি গ্রেট ওমরি মসজিদ। যে স্থান একসময় ছিল ইবাদত ও শান্তির প্রতীক, তা পরিণত হয়েছিল ধ্বংসস্তূপে।
এ বছরের রমযান যুদ্ধবিরতির মধ্যে। ইফতারের সময় আর বোমার আঘাতে জমিন কাঁপে না। ফজরের নীরবতা ভেঙে আর বিস্ফোরণের শধ শোনা যায় না। এখন অন্তত এই ভয় নেই যে, ঘর সাজানোর রঙিন বাতি ঘরগুলোকে হামলার লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে দেবে। ব্যথা আর বিপর্যয়ের মাঝেও গাজার রাস্তায় জীবন ফিরে আসার চেষ্টা করছে। যেসব দোকানপাট এখনো টিকে আছে, সেগুলো আবার খুলেছে। ফেরিওয়ালারাও ফিরে এসেছে। নুসেইরাতের বড় সুপারমার্কেট আবার চালু হয়েছে। এসব পণ্য অধিকাংশ মানুষের সাধ্যের বাইরে, যারা তাদের জীবন ও জীবিকা হারিয়েছে। তাহলে গাজার বেশির ভাগ মানুষ এবার ইফতারে কী খাবে? হয়তো টিনজাত খাবারের চেয়ে একটু ভালো কিছু, একটা সাধারণ খাবার, হয়তো ভাত, মোলোখিয়া বা যতটুকু সবজি তারা কিনতে পারবে।

কিন্তু খাবারই একমাত্র জিনিস নয়, যা এ বছরের রমযানের টেবিল থেকে হারিয়ে যাবে। যুদ্ধের এই সময়ে ৪৮ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। পুরো পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে, সরকারি তালিকা থেকে তাদের নামই মুছে গেছে। তারা আর কখনো রমযান পালন করবে না। অসংখ্য ইফতার টেবিলে থাকবে এক শূন্য আসন। একজন বাবা, যার কণ্ঠে আর শোনা যাবে না সন্তানদের ডাক। এক ছেলে, যে আর অধীর আগ্রহে ইফতারের অপেক্ষা করবে না। এক মা, যার হাতে আর কখনো তৈরি হবে সুস্বাদু খাবার। উৎসবের আমেজ হয়তো নেই, কিন্তু রমযানের মূল সত্তা টিকে আছে। এটি ক্ষমার সময়। এটি আল্লাহর কাছে ঘনিষ্ঠতা ও আধ্যাত্মিক ধৈর্য খোঁজার মাস। মসজিদ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, কিন্তু ফিলিস্তিনবাসীর বিশ্বাস ভাঙেনি। তাঁবুর নিচে তারাবির নামায পড়ছেন তারা।

Copyright © Puber Kalom All rights reserved.| Developed by eTech Builder

গাজায় রমযান: ধ্বংসস্তূপের মাঝে ঈমানি শক্তিতে অবিচল ফিলিস্তিনবাসী

আপডেট : ২ মার্চ ২০২৫, রবিবার

গাজা: শুরু হয়েছে পবিত্র রমযান। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মুসলমানদের মতো ইসরাইলি আগ্রাসনে বিধ্বস্ত গাজার মানুষেরাও শুরু করেছেন রোযা। তবে অন্যান্য দেশ বা অঞ্চলের মানুষ যতটা উৎসাহ, উদ্দীপনা আর উচ্ছ্বাস নিয়ে রমযান শুরু করেছেন, শোকাহত গাজাবাসীর সেই সুযোগ ছিল না। কিন্তু তাদের বিশ্বাসের কোনো কমতি নেই। যুদ্ধের আর্তনাদ এখনো কানে বাজছে। এই যুদ্ধবিরতি স্থায়ী হবে কি না, কেউ জানে না। সবাই উদ্বিগ্ন ভবিষ্যৎ নিয়ে। সবারই আশঙ্কা, যদি আবার যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়!
কিন্তু গত বছরের রমযান ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেটা ছিল অকল্পনীয়ভাবে ভয়াবহ। চারপাশে শুধুই ক্ষুধা। সারা দিন উপবাস। বিদ্যুৎ না থাকায় বিস্বাদ টিনজাত খাবার অন্ধকারে চিবিয়ে খেতে হত। গাজাবাসীর কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল রমযানের আনন্দময় আবহ। তারা ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষা করত মাগরিবের আযানের জন্য, ফজরের আযানের জন্য; কিন্তু সেই ডাক কখনো শোনা যেত না। সব মসজিদ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। যারা আযান দিতে চেয়েছিল, তারাও ভয় পেয়েছিল। ভয় ছিল, তাদের কণ্ঠস্বর হয়তো বোমার নিশানা বানিয়ে দেবে, তারা হয়তো হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে। কাছের মসজিদের লাউডস্পিকারে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠ শোনার বদলে ইফতার করত ক্ষেপণাস্ত্রের বিকট আওয়াজ আর গোলাগুলির শধে। গাজার সবচেয়ে সুন্দর ও ঐতিহাসিক মসজিদগুলোর একটি গ্রেট ওমরি মসজিদ। যে স্থান একসময় ছিল ইবাদত ও শান্তির প্রতীক, তা পরিণত হয়েছিল ধ্বংসস্তূপে।
এ বছরের রমযান যুদ্ধবিরতির মধ্যে। ইফতারের সময় আর বোমার আঘাতে জমিন কাঁপে না। ফজরের নীরবতা ভেঙে আর বিস্ফোরণের শধ শোনা যায় না। এখন অন্তত এই ভয় নেই যে, ঘর সাজানোর রঙিন বাতি ঘরগুলোকে হামলার লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে দেবে। ব্যথা আর বিপর্যয়ের মাঝেও গাজার রাস্তায় জীবন ফিরে আসার চেষ্টা করছে। যেসব দোকানপাট এখনো টিকে আছে, সেগুলো আবার খুলেছে। ফেরিওয়ালারাও ফিরে এসেছে। নুসেইরাতের বড় সুপারমার্কেট আবার চালু হয়েছে। এসব পণ্য অধিকাংশ মানুষের সাধ্যের বাইরে, যারা তাদের জীবন ও জীবিকা হারিয়েছে। তাহলে গাজার বেশির ভাগ মানুষ এবার ইফতারে কী খাবে? হয়তো টিনজাত খাবারের চেয়ে একটু ভালো কিছু, একটা সাধারণ খাবার, হয়তো ভাত, মোলোখিয়া বা যতটুকু সবজি তারা কিনতে পারবে।

কিন্তু খাবারই একমাত্র জিনিস নয়, যা এ বছরের রমযানের টেবিল থেকে হারিয়ে যাবে। যুদ্ধের এই সময়ে ৪৮ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। পুরো পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে, সরকারি তালিকা থেকে তাদের নামই মুছে গেছে। তারা আর কখনো রমযান পালন করবে না। অসংখ্য ইফতার টেবিলে থাকবে এক শূন্য আসন। একজন বাবা, যার কণ্ঠে আর শোনা যাবে না সন্তানদের ডাক। এক ছেলে, যে আর অধীর আগ্রহে ইফতারের অপেক্ষা করবে না। এক মা, যার হাতে আর কখনো তৈরি হবে সুস্বাদু খাবার। উৎসবের আমেজ হয়তো নেই, কিন্তু রমযানের মূল সত্তা টিকে আছে। এটি ক্ষমার সময়। এটি আল্লাহর কাছে ঘনিষ্ঠতা ও আধ্যাত্মিক ধৈর্য খোঁজার মাস। মসজিদ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, কিন্তু ফিলিস্তিনবাসীর বিশ্বাস ভাঙেনি। তাঁবুর নিচে তারাবির নামায পড়ছেন তারা।