মানবিকতার কাছে মুছে গেল ধর্মীয় ভেদাভেদ, একজন টিপু সুলতান ও এক হিন্দু তরুণী

- আপডেট : ৯ জানুয়ারী ২০২৩, সোমবার
- / 10
সাইয়েদ আলি মুজতাবা: আজকের দিনে ভারতে এমন এক পরিবেশ গড়ে উঠেছে যে, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ঘৃণা-বিদ্বেষের লহর বইছে। কিংবা বলা ভালো, লহর নয়, আছড়ে পড়েছে সুনামি। অবশ্য সুনামি তার বিধ্বংসী প্রভাব রেখে থেমে যায়। কিন্তু প্রাচীন সভ্যতার দেশ ভারতে এই প্রবাহ চলছে অব্যাহতভাবে। বিশেষ করে সংখ্যালঘু মুসলিম, খ্রিষ্টান ও তথাকথিত অস্পৃশ্য জাতি দলিত, আদিবাসী এবং ওবিসিদের বিরুদ্ধে। আর তার মধ্যেই একটি ভিন্ন রকমের খবর অনেকেরই দৃষ্টি কেড়েছে।
মধ্যপ্রদেশের দেওয়াসের ঘটনা এটি। বছরের প্রথমদিন ১ জানুয়ারি টিপু সুলতান অদম্য সাহস ও তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং প্রত্যুৎন্নমতিত্ব দ্বারা এক তরুণীর প্রাণ বাঁচিয়ে সকলের কাছ থেকে প্রশংসা অর্জন করেছেন। তরুণীটির নাম মোনালি কৌশল। সে একজন হিন্দু তরুণী। মোনালি শিপ্রা নদীতে আচমকা ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। পরে জানা যায়, এর কারণ হচ্ছে, তার হিন্দু প্রেমিক তার সঙ্গে প্রতারণা করে সম্পর্কচ্ছেদ করেছে। আর সেই কারণেই মোনালির আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত।
পাড়ে বসে যারা তরুণীটিকে ডুবে যেতে দেখছিল তাদের মধ্যে ছিল এক মুসলিম তরুণ টিপু সুলতান। নদীর পাড়ে সকলে হায় হায় করলেও টিপু সুলতান কিন্তু চুপ করে থাকতে পারেনি। সে ওই তরুণীর প্রাণ বাঁচাবার জন্য সচেষ্ট হয়ে ওঠে। সে দ্রুত চিন্তা করে এক সাহসী প্রচেষ্টায় শুরু করে।
টিপু সুলতান সে সময় রাস্তা দিয়ে যাওয়া ট্রাকগুলিকে থামিয়ে ড্রাইভারের কাছে একটি বড় দড়ি চাইতে থাকে। সাধারণত মালবাহি ট্রাকে এই ধরনের দড়ি থাকে। একজন ট্রাক ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে টিপুকে একটি লম্বা দড়ি দেয়। টিপু দড়িটি ট্রাকের সঙ্গে শক্ত করে বাঁধে এবং দড়িটি হাতে নিয়ে খরস্রোতা নদীতে নেমে পড়ে। সে খানিকটা সাঁতার কেটে ডুবন্ত মোনালির কাছে পৌঁছায়। এই সময় টিপু দাঁতে করে দড়িটি চেপে ধরেছিল। টিপু লক্ষ্য করে, মোনালি তখনও বেঁচে রয়েছে। সে মোনালিকে তোলার চেষ্টা করে। পাড় থেকে শত শত লোক তার এই জীবনবিপন্ন করা কাজ লক্ষ্য করে তাকে উৎসাহিত করতে থাকে।
টিপু সুলতান নামক তরুণটি চিৎকার করে ট্রাক ড্রাইভারকে তার লরি আস্তে আস্তে করে এগিয়ে নিয়ে যেতে বলে। যাতে দড়ির সাহায্যে মোনালিকে নিয়ে টিপু পাড়ে উঠতে পারে। এবার কুলের কাছাকাছি আসা স্থানীয়রাও এই দুজনকে সাহায্য করে এবং তারা নিরাপদ জায়গায় উঠে আসে। প্রথমে মোনালিকে সেখানেই প্রাথমিক শুশ্রুষা করা হয় এবং তাকে বমি করিয়ে পেটে যাওয়া জল বের করা হয়। এরপর দ্রুত মোনালিকে স্থানীয় এক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। জানা গেছে, এখন তার অবস্থা মোটামুটি ভালো। দেওয়াসের বাসিন্দারা টিপুকে একজন ‘হিরো’ হিসেবে অভিনন্দন জানাতে শুরু করে।
টিপু যখন মোনালিকে উদ্ধার করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন সে ভাবেনি তরুণীটি হিন্দু না মুসলিম। দেওয়াসের বাসিন্দারাও মোনালির প্রাণ বাঁচানো টিপু সুলতানের জাতপাত, ধর্ম, পরিচয় সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে তার গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দেয়। আর তাকে নিজেদের কাঁধে তুলে নেয় এবং একটি আন¨ মিছিল বের করে। টিপুর সাহসীকতাকে তারা ধর্মীয় বিভেদের মধ্যে মানবিকতার জয় হিসেবে সেলিব্রেট করতে শুরু করে। এমনকি পরে দেওয়াসের পুলিশও টিপুকে মানপত্র দিয়ে অভিনন্দন করে।
দেশে যখন হঠাৎই ধর্মীয় বিভাজন তুঙ্গে উঠছে, বলা হচ্ছে মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, সেই সময় টিপুর এই কাজ প্রমাণ করে দেয়, সংকটের সময় হিন্দু-মুসলিম একত্রিত হয়ে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারে। আর শুধু টিপু নয়, দেওয়াসের বাসিন্দারা ভেদাভেদ ভুলে যেভাবে টিপুকে আন্তরিকভাবে প্রশংসায় ভরিয়ে দেয়, তাতে বোঝা যায়, এখনও ভারতবর্ষ কিন্তু ভারতবর্ষই রয়েছে। এস ওয়াজেদ আলির ভাষায় ‘সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে।