পুবের কলম, দ্বীন দুনিয়া ডেস্ক: বদলে গেছে পৃথিবী। দ্রুত বদলাচ্ছে পৃথিবীর রং-রূপ। ছোট হয়ে আসছে পৃথিবীর আকার-আয়তন। দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ। এক সময় জ্ঞানের ছোট্ট একটি কণিকা জানার জন্যও মানুষকে পাড়ি দিতে হ’ত মাইলের পর মাইল। ছুটতে হত দেশ থেকে দেশান্তরে। একত্ববাদের বার্তা নিয়েও সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি দিয়ে সাহাবায়ে কেরামকে যেতে হয়েছে সেই দূর দেশ চিন। দ্বীন ও ঈমানের খোঁজে সালমান ফার্সিকে চলতে হয়েছে যুগের পর যুগ ধরে পৃথিবীর পথে পথে। ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন, পরিব্রাজক ইবনে বতুতা, পারস্যের শেখ সাদীদেরওতো জ্ঞানের অন্বেষা তাড়া করে নিয়ে গিয়েছিল দূর অজানায়।
নানা গোত্র ও সম্প্রদায়ের মানুষের জীবনাচার থেকে অভিজ্ঞতার ঝুলিকে সমৃদ্ধ করতে ও সত্য-সুন্দরের বাণী ছড়িয়ে দিতে আহার-নিদ্রাহীন, বন্ধুর পথ মাড়িয়ে ঘুরে ঘুরে পার করতে হয়েছে তাদের কত দিন-রজনী। তবে বিশ্বায়নের মহানিয়ামত আজ ৫১ কোটি ৬৬ হাজার বর্গ কি.মি. ব্যাপ্ত বিশাল এ পৃথিবীকে এনে দিয়েছে হাতের মুঠোয়। যেন পরিকল্পিত সাজানো একটি সংসার। বিজ্ঞানের এ শতকে তাবৎ দুনিয়ার চ্যালেঞ্জ গ্রহণে বিশ্বায়নই হতে পারে মুসলমানদের জন্য মূসার লাঠি, দাউদের লৌহগালা হাত, নবী মুহাম্মদ সা.-এর মু’জিজা আর প্রেরণাপ্রাপ্ত বান্দাহ্দের কেরামত।
আপনার অবস্থান থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে দূরের মানুষটির কাছে শান্তি ও কল্যাণের কথা পৌঁছাতে বা তার কাছ থেকে কল্যাণময় কিছু জানতে আজ আর প্রয়োজন নেই ঘর-সংসার সব ছেড়ে নিরুদ্দেশ হেঁটে চলার। প্রয়োজন নেই গাছের পাতা, পশুর চামড়া বা পাথরের টুকরায় কিছু লিখে পাঠানোরও।
কাগজের পাতায় লিখে ডাকহরের মাধ্যমে এক মাস, এক সপ্তাহে পাঠাবেন? না। সেই যুগও শেষ হয়ে এসেছে। আপনার হাতের স্মার্ট ফোন, আইপ্যাড, ট্যাব, ল্যাপটপ বা কম্পিউটারই আজকে সত্য ও সুন্দর প্রচারের যুগোপযোগী মাধ্যম। একটি টিভি চ্যানেলে আপনার ৫ মিনিটের আলোচনা ৫ বছর ধরে ফেরি করে আলোচনা করার চেয়েও অধিক ক্রিয়াশীল হতে পারে।
একটি দৈনিকে লেখা আপনার ছোট্ট একটি নিবন্ধও যুগ যুগ পর্যন্ত মানবতার কল্যাণ সাধন করতে পারে। আল্লাহ্তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘তুমি মানুষকে আপন প্রতিপালকের পথে ডাক, কৌশল ও উত্তম উপদেশের মাধ্যমে এবং তাদের সঙ্গে আলোচনা কর উত্তম পন্থায়। (সূরা নাহাল, আয়াতঃ১২৫)
ইসলাম যুগের চাহিদাকে কখনই অস্বীকার করেনি। কৌশল বা সময়ের ভাষায় মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকাই ইসলামের নির্দেশ। প্রত্যেক নবী-রাসূল আবির্ভূত হয়ে ছিলেন যুগ চ্যালেঞ্জ সক্ষম জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রজ্ঞা ও কৌশল নিয়ে। হযরত মূসা আ.-এর যুগে ছিল জাদুবিদ্যার জয়জয়কার।
আল্লাহ মূসা আ.-এর হাতের লাঠিকে বানিয়ে দিয়েছিলেন জাদুর কাঠি। তিনি তাঁর হাতের লাঠি দিয়েই তৎকালীন যুগের খ্যাতনামা জাদুকরদের পরাজিত করে দিতেন। হযরত দাউদ আ.-এর যুগ ছিল লৌহসামগ্রীর উৎকর্ষতার যুগ- আল্লাহ্ দাউদ আ.-এর হাতে এমন ক্ষমতা দিলেন যে, তাঁর হাতের ছোঁয়ায় লোহা মোমের মতো গলে যেত।
হযরত ঈসা আ.-এর যুগ ছিল চিকিৎসা বিদ্যার জন্য বিখ্যাত— আল্লাহ হযরত ঈসা আ.-কে এমন ক্ষমতা দান করেন যে, তার হাতের স্পর্শেই অনেক জটিল রোগী সুস্থ হয়ে উঠত। আমাদের নবী মুহাম্মদ সা.-এর যুগ ছিল সাহিত্যের স্বর্ণযুগ- আল্লাহতায়ালা তার ওপর সাহিত্যপূর্ণ ও প্রজ্ঞাময় একটি গ্রন্থ কুরআন অবতীর্ণ করলেন।
পবিত্র কুরআনের অলংকারপূর্ণ শব্দ, বাক্য ও বাক্যের অন্তঃমিল, কথা, সুর আর প্রজ্ঞার কাছে হার মানল সব কবির কবিতা, সব সাহিত্যিকের সাহিত্য সাধনা। কুরআনের ভিত্তিতে স্থাপিত হল এক নতুন সমাজ, নতুন সভ্যতা। প্রয়োজন হল এ সভ্যতার প্রচার ও প্রসারের।
read more: কর্নাটকে ওয়াকফ সম্পত্তি উদ্ধারে ৪১০৮ মামলা দায়ের
আল্লাহর রাসূল সা. তাঁর যুগের সবচেয়ে আধুনিক পদ্ধতিগুলো বেছে নিলেন মানবতার কল্যাণে, ধর্মের প্রচারে। তখন আরবের নিয়ম ছিল সংবাদ বা গুরুত্বপূর্ণ কোনও বিষয়ের প্রতি আহ্বানের জন্য তারা পাহাড়ের চূড়ায় উঠে জোরে আওয়াজ করত।
পরে লোকজন একত্রিত হলে তারা তাদের উদ্দিষ্ট বিষয় খুলে বলত। আল্লাহর রাসূল সা.-ও ওহি পেয়ে পাহাড়ের ওপর চড়ে মক্কার লোকদের ডেকে তাওহিদের বাণী শোনান। পশুর চামড়ায় চিঠি লিখিয়ে তৎকালীন পৃথিবীর অনেক রাজা-বাদশাহদের উদ্দেশে ঈমানের দাওয়াত পাঠান।
একত্ববাদের প্রচারে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে তাঁর একান্ত প্রতিনিধিদের পাঠিয়ে কূটনীতিক তৎপরতাও চালান। তিনি তাঁর যুগের আধুনিকতর সব পদ্ধতির ব্যবহার করে আমাদের সামনে আদর্শ স্থাপন করে গেছেন- তাঁর দেখানো পদ্ধতির পাশাপাশি যুগের ভাষায়ও দাওয়াত দেওয়ার।
প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষতার এ সময় কুরআন সুন্নাহের আলোকে আপনার লেখা ফেসবুকের একটি স্ট্যাটাস, ইউটিউবে আপলোড করা আপনার একটি বয়ান, মেইলে পাঠানো আপনার একটি বার্তাই পৃথিবীর যে-কোনও দেশের, যে-কোনও ভাষার, যে-কোনও ধর্মের, যে কাউকে দিতে পারে আলোর সন্ধান।
আল্লাহর অনুগ্রহ যে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আমাদের দায়িত্ব পালনে সহায়ক হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। এজন্য প্রয়োজন পরিকল্পিত প্রযুক্তির ব্যবহার। প্রযুক্তির মাধ্যমে ধর্মের প্রচারে প্রাথমিকভাবে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে তা হল– প্রতিটি মসজিদের জন্য একটি স্বতন্ত্র ওয়েবসাইট তৈরি করা।
ওয়েবসাইটে এক সপ্তাহের মসজিদভিত্তিক সব কর্মসূচির ঘোষণা, চলতি সপ্তাহের বিশেষ ধর্মীয় বা রাষ্ট্রীয় দিবসের তাৎপর্য ও করণীয়বিষয়ক আলোচনা, জুমার খুৎবার বাংলা অনুবাদ, ইসলামের শিষ্টাচার, সৌন্দর্য, জীবনাচার ও ইতিহাস-ঐতিহ্যের আলোকে কর্মমুখী, উদ্ভাবনী প্রেরণা সংবলিত গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ-নিবন্ধ ইত্যাদি আপলোড করতে হবে।
মসজিদের জন্য একটি ফেসবুক পেজও খোলা যেতে পারে, যাতে সব শ্রেণির মুসল্লি দূর কর্মস্থলে থেকেও মসজিদভিত্তিক জীবন পরিচালনা করতে পারেন। প্রতিটি মাদ্রাসার জন্যও থাকা চাই একটি বৃহৎ কলেবরে ওয়েবসাইট। যেখানে মাদ্রাসার কর্মসূচি, পাঠ্যসূচির পশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ক্লাসের লেকচার, জ্ঞানের নব আবিষ্কৃত দিক-দিগন্ত, বিজ্ঞান ও ধর্মের তুলনামূলক আলোচনা, গবেষকদের গবেষণালব্ধ চিন্তাধারা, দাওয়াতের প্রক্রিয়া, মুসলমানদের জাগ্রত করার পরিকল্পনা ইত্যাদি বিষয়কে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হবে।
ব্যক্তিগতভাবে ফেসবুক, ট্যুইটারে অ্যাকাউন্ট খুলে দিনের বিশেষ একটি সময় নির্ধারণ করে ধর্মের প্রচারে মানবতার কল্যাণে কাজ করা যেতে পারে।
এলিট পার্সন যাদের কাছে হয় তো ফেসবুক-ট্যুইটারেও আপনি পৌঁছতে পারছেন না; তাদের মেইল করুন উত্তম উপদেশের মাধ্যমে। ব্লগেও লেখালেখি করুন। ইসলামের রূপ-সৌন্দর্য তুলে ধরুন বিশ্ববাসীর কাছে নবীজি সা.-এর প্রেম-ভালোবাসা ও দরদ নিয়ে। ধর্মের প্রচারে প্রযুক্তি হোক মুমিনের সঙ্গী।