খোলা আকাশের নিচে ক্ষুধার্ত-শীতার্ত মানুষেরা, একফোঁটা জলও দিতে নারাজ অসম সরকার

- আপডেট : ১৩ জানুয়ারী ২০২৩, শুক্রবার
- / 8
বিশেষ প্রতিবেদকঃ টানা দু’দিনের উপর উপোস। পেটে দানা পড়েনি কারোরই। আর একদিকে প্রবল শীত। আট মাসের শিশুকন্যাকে কোলে নিয়ে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে থরথর কাঁপছে বছর ২২-এর আনোয়ারা বেগম। খিদের জ্বালায় কোলের শিশুটি অনবরণ কেঁদে চলেছে। আনোয়ারা কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে।
বৃহস্পতিবার বিকেলে এমন বেদনাদায়ক ছবি দেখা গেল অসমের লখিমপুর এলাকার পাভো বনাঞ্চলে। এই বনাঞ্চলে বসবাসরত সাত শতাধিক পরিবারকে উচ্ছেদ করেছে হিমন্ত বিশ্ব শর্মার সরকার। মঙ্গলবার ভোর থেকে শুরু হয় উচ্ছেদ অভিযান। বুধবারও চলে উচ্ছেদ। উচ্ছেদ হওয়া মানুষেরা এখন তীব্র ঠান্ডায় খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন। রান্না করার উপায় নেই। হাতে নেই দোকান থেকে খাবার কিনে আনার মতো সাধ্য।
সরকারও কোনও ত্রাণ দিতে ইচ্ছুক নয়। কেউ দুটি টিন দাঁড় করিয়ে তার নিচে কোনওরকমে রাত পার করেছেন। কারও মাথার উপর ছাউনি দেওয়ার মতো হাতের কাছে কিছুই নেই।
মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা আগেই ঘোষণা করেছেন, উচ্ছেদ হওয়া মানুষদের তাঁর সরকার একফোঁটা জলও দেবে না। মুখ্যমন্ত্রীর কথামতো সরকার এই অসহায় মানুষদের ত্রাণ সাহায্য তো দেয়নি, এমনকি অসহায় মানুষদের জন্য খাবার নিয়ে আসা বিভিন্ন সংগঠনের কর্মীদের ঢুকতেও দিচ্ছে না পুলিশ।
গত ২০ দিন ধরে অসমের বিভিন্ন জেলায় উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছে অসম সরকার।
সরকারি বা বনাঞ্চলের জমি দখলমুক্ত করতেই এই অভিযান বলে প্রশাসনের তরফে বলা হচ্ছে। গত ১৯ ডিসেম্বর। নগাঁও জেলার বটদ্রবায় প্রায় ৩০০ পরিবারকে উচ্ছেদ করেছে অসম সরকার। এরপর ২৬ ডিসেম্বর বরপেটা জেলার বাগবারে বিধানসভা এলাকায় প্রায় ৫০টি পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়। মঙ্গলবার ও বুধবার লখিমপুর জেলার নাওবইচা বিধানসভা এলাকার পাভো বনাঞ্চলে উচ্ছেদ করে হিমন্তের নিয়ন্ত্রণাধীন পুলিশ। বিস্ময়করভাবে দেখা যাচ্ছে, যেসব অঞ্চলে জবরদখল উচ্ছেদের নামে চলছে বিজেপি সরকারের বুলডোজার, সেগুলি সবই বাংলাভাষি মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা। প্রথমে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী তকমা সেঁটে উচ্ছেদ করা হয়েছে এই হতদরিদ্র মুসলিম পরিবারগুলিকে। পরে এদের হাতে জমির পাট্টা নেই বলে উচ্ছেদ চালানো হয়েছে। এখন উচ্ছেদ হওয়া মানুষগুলো জমির পাট্টা দেখালেও কোনও কাজ হচ্ছে না, প্রশাসন সেই পাট্টার দিকে নজরও দিচ্ছে না।
স্থানীয়দের অভিযোগ, যাদের উচ্ছেদ করা হয়েছে, তাদের প্রায় প্রত্যেকেরই ওই বনাঞ্চলে বসবাসের জন্য জমির পাট্টা রয়েছে। যে পাট্টা বহু বছর আগে তৎকালীন সরকার দিয়েছিল।
এদের প্রায় সকলেই নদীভাঙনে ভিটে-মাটি, বসতবাড়ি হারানো মানুষ। আগের সরকারই তাদের ওই স্থানে বসবাসের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। সরকার তাদের আলাদা জমি দেয়নি। কিন্তু বনাঞ্চলে বসবাসের অনুমোদন দিয়েছিল। তিন-চার দশক ধরে তাঁরা এখানেই বসবাস করে আসছেন। বংশ পরম্পরায় তারা অসমেরই নাগরিক। এখানে বসবাস করা অনেক পরিবারই বনাঞ্চল অধিকার আইনে জমির অধিকারও পেয়েছিলেন। কিন্তু তাতে কি? এখন হিমন্ত বিশ্ব শর্মা পরিচালিত বিজেপি সরকারের কাছে সেই নথিপত্রের কোনও গুরুত্বই নেই। গত সেপ্টেম্বর মাসে তাদের উচ্ছেদের নোটিশ ধরায় সরকার। সেদিনই এলাকার মানুষজন সার্কেল অফিসে ছুটে গিয়ে জমির নথি দেখিয়েছিলেন। কিন্তু নথিগুলি ভুয়ো বলে প্রশাসনের তরফে জানিয়ে দেওয়া হয়। তাঁরা উচ্ছেদ হওয়া মানুষদের পাশে দাঁড়াননি বলে অভিযোগ।
সারা অসম সংখ্যালঘু ছাত্র সংস্থা বা আমসু অভিযোগ করেছে, পাভো বনাঞ্চলে রয়েছে মিশ্র জনগোষ্ঠীর বসবাস। কিন্তু বেছে বেছে কেবল মুসলিমদের উচ্ছেদ করেছে সরকার। ট্রাক্টর চালিয়ে কেবল মুসলিমদের চাষ করা জমির ফসল নষ্ট করা হয়েছে। আমসুর সাধারণ সম্পাদক আমিনুর রহমান বলেন, সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোন থেকে উচ্ছেদ অভিযান চালাচ্ছে হিমন্ত বিশ্ব শর্মার সরকার। অথচ তাদের পুনর্বাসন বা ত্রাণ দেওয়া তো দূরের কথা মানবিকতার সামান্যতম উদ্যোগত সরকার দেখাচ্ছে না। অন্যদেরও অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়াতে দিচ্ছে না।