বর্ডার থেকে বিবিসি-র সরেজমিন রিপোর্ট, সাংবাদিকের চোখে সীমান্ত গ্রামের রাত-দিন

- আপডেট : ২৭ নভেম্বর ২০২১, শনিবার
- / 3
কিছুদিন আগে কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গ– পঞ্জাব ও অসমে সীমান্ত থেকে ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকার নিয়ন্ত্রণভার বিএসএফ-এর কাছে হস্তান্তর করার কথা ঘোষণা করেছে। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত রয়েছে ২২১৭ কিলোমিটার। ফলে পশ্চিমবঙ্গের দুই ২৪ পরগনা– মালদহ– মুর্শিদাবাদ– দুই দিনাজপুর– কোচবিহার– জলপাইগুড়ি– নদিয়া– দার্জিলিং-এর বিস্তীর্ণ অঞ্চল বিএসএফ-এর সরাসরি নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে।
স্বাভাবিকভাবেই সীমান্ত এলাকা বেড়ে যাওয়ায় পশ্চিমবঙ্গের কয়েক কোটি জনগণ ব্যাপক অসুবিধার মধ্যে পড়বেন। ফলে এই এলাকার মানুষ শঙ্কায় রয়েছেন– আপত্তি জানাচ্ছেন। বিবিসি বাংলার সাংবাদিক অমিতাভ ভট্টশালী সম্প্রতি গিয়েছিলেন ২৪ পরগনার সীমান্ত এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলতে। দিন ও রাতের এই সফরে তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন।
ভারতের দিকে সীমান্তবাসী মানুষের জীবনের চলাফেরা– চাষাবাদ– বিয়ে-শাদি– এমন কি ঘর থেকে বাথরুমে যাওয়ার ওপরেও যেভাবে নজরদারি করে বিএসএফ– তা অবিশ্বাস্য মনে হয়। এই লেখার শিরোনাম এরকম হতে পারত, ‘বিএসএফের কাজের এলাকা বৃদ্ধি নিয়ে কী ভাবছেন সীমান্তের মানুষ?– অথবা এরকমই কিছু। কারণ এই লেখাটা ওই বিষয় নিয়েই হওয়ার কথা ছিল। বিএসএফের কাজের এক্তিয়ার বৃদ্ধি নিয়ে সীমান্ত অঞ্চলের মানুষের প্রতিক্রিয়া কী– সেটা জানতেই কয়েকদিন আগে গিয়েছিলাম উত্তর ২৪ পরগণার সীমান্ত ঘেঁষা কিছু গ্রামে। তবে সকাল থেকে বেশ রাত পর্যন্ত ওই অঞ্চলে কাটিয়ে মানুষের কথা শুনে আর কিছু কিছু ঘটনা দেখে এই লেখার বিষয়-ভাবনা যেমন বদলাতে হল– তেমনই এটা ছাড়া আর কোনও শিরোনামও মাথায় এল না।
কারণ– সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাঁটাতারের বেড়ার পাশে থাকা নারী-পুরুষ বলছিলেন– কীভাবে প্রায় ২৪ ঘণ্টাই বিএসএফ সদস্যদের নজরদারিতে থাকতে হয় তাদের। প্রতিটা কাজের জন্যই দরকার বিএসএফের অনুমতি
সকালে উঠে মাঠে গরু নিয়ে যেতে গেলে অনুমতি– বাজার থেকে জামা বা সবজি কিনতে গেলে তল্লাশি– প্রসূতি নারীর পেট কেন ফুলে আছে– সেই প্রশ্নের জবাব মেনে নিতে হয়েছে সীমান্তবাসীদের। দিনের শুরুটা করেছিলাম স্বরুপনগর এলাকার হাকিমপুর এলাকা থেকে। তারালি গ্রামের বাসিন্দা মেহেরুন্নিসা গাজির সঙ্গে কথা বলার সময়েই এক বিএসএফ সদস্য কাঁধে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল নিয়ে তার বাড়ির উঠোন পেরিয়ে পিছনের দিকে চলে গেলেন চোখের সামনেই। বাড়ির কারও অনুমতি নেওয়াও হল না। দেখলেন তো– আপনার সামনে দিয়েই কীভাবে বাড়ির উঠোন দিয়ে চলে গেল। বাড়িতে মেয়ে বউরা আছে– জিজ্ঞাসা করার কোনও ব্যাপারই নেই এদের– বলছিলেন মেহেরুন্নিসা গাজি। তার সঙ্গে কথা বলে যে দিনের শুরু– সেটা শেষ হয়েছিল বেশ রাতে– ওই হাকিমপুর থেকে অনেকটা দূরে– পেট্রাপোল সীমান্তের কাছাকাছি কালিয়ানি নামের একটা গ্রামে। গ্রামের বাসিন্দা শর্মিলা সরকার আর মেহেরুন্নিসা গাজির কথার মধ্যে বিশেষ ফারাক পেলাম না।
বাথরুম যেতে গেলও টর্চ মারে
শর্মিলা সরকার বলছিলেন– এদের ডিউটি তো করার কথা বর্ডারে। কিন্তু এরা নজর রাখে আমাদের বাড়ির ওপর। বাসন মাজছি– বা কাপড় কাচছি– গান গাইতে গাইতে চলে গেল। বাড়ির পুরুষরা কিছু বললে গালি দেয়। আবার রাতে বাথরুমে যাব– টর্চ মেরে দেখে যে কে যাচ্ছে। রাতে ঘুমিয়েও নিস্তার নেই– বেড়ার গায়ে বাড়ি দেবে।
সবসময়ে আমাদের দেখছে তারা– রাস্তায় বেরলেই জিজ্ঞাসা করবে– ও বৌদি কোথা থেকে এসেছেন– বাংলাদেশ থেকে নাকি? ক্ষোভ শর্মিলা সরকারের। শুধু দোকান বাজার থেকে ফেরার পথে নয়– বিয়ে করতেও বিএসএফের অনুমতি লাগে সীমান্ত অঞ্চলে।
হাকিমপুর গ্রামেরই গৃহবধূ জসমিনা বিবির কথায়– বাড়িতে বিয়ে-শাদি থাকলে আগে থেকেই ক্যাম্পে জানাতে হয়। আর এখানে এত চেকিং– এত চেকিং যে বাইরের লোক এসব জায়গায় বিয়ে দিতেই চায় না। তাই গ্রামের মধ্যেই বিয়ে-শাদি সারতে হয়।
ভারতীয় পরিচয়পত্র সবসময়ে দেখাতে হয়
ভারতীয় ভূখণ্ডেও তাই এই অঞ্চলের মানুষের কাছে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ তাদের নাগরিকত্বের পরিচয়পত্র। যে কোনও জায়গায় সেই পরিচয়পত্র দেখতে চাইতে পারেন বিএসএফ সদস্যরা। নিজে দেখলামও ব্যাপারটা একাধিকবার। হাকিমপুর গ্রামে মেহেরুন্নিসা গাজির বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে যখন কথা বলছিলাম– দূরে এক বিএসএফ কয়েকজন নারী-পুরুষের কাছে দাঁড়িয়ে কিছু জানতে চাইছিলেন। তারা যখন আমার কাছাকাছি এলেন– জিজ্ঞাসা করেছিলাম– কি জানতে চাইছিল আপনাদের কাছে? জবাবে রেণু গাজি আর রুহুল আমিন সর্দার বলছিলেন– আইকার্ড দেখতে চায়। সবসময়ে কাছে রাখতে হয় পরিচয়পত্র। ব্যাগ থেকে বার করে ভোটার পরিচয়পত্র দেখালেন আমাকেও। বললেন– ব্যাগে কী আছে দেখাও। একবার ওঠ– একবার বসো– ব্যাগে বাড়ি মারো– বলছিলেন রেণু গাজি।
রুহুল আমিন সর্দার বলছিলেন– রাস্তায় বেরোনই কঠিন। হয়তো বাজার থেকে আসছি– একটু সন্ধ্যা হয়েছে– বলবে ব্যাগে করে কী নিয়ে যাচ্ছি ফেন্সি আছে নাকি– বিড়ি আছে নাকি– লাইনম্যানি করছিস না কি। বলেই ব্যাগে একটা লাঠির বাড়ি দেবে। এই এলাকায় ফেন্সি মানে নিষিদ্ধ ফেন্সিডিল আর লাইনম্যানি শধের অর্থ পাচারকারী।
নারীদের ব্যাগ তল্লাশি করে পুরুষ সীমান্তরক্ষী
রেণু গাজিকে প্রশ্ন করেছিলাম– যিনি আপনাকে জিজ্ঞাসা করলেন– তিনি তো নারী কনস্টেবল নন– পুরুষ! নারী কনস্টেবল থাকে না? রেণু গাজির সঙ্গে থাকা আরও দু একজন নারী বলে উঠলেন– না না– মহিলা কনস্টেবল নেই।
সব জায়গায় হয়তো নারী প্রহরী থাকে না– কিন্তু বেশ কিছু জায়গায় বিএসএফের নারী কনস্টেবলদের সন্ধ্যার অন্ধকারে একা একা দাঁড়িয়ে ডিউটি করতেও দেখেছি। আর বাহিনীর পূর্ব কমান্ডের প্রধান– অতিরিক্ত মহানির্দেশক ওয়াই বি খুরানিয়ার কথায়– পুরো ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে হাজার চারেক নারী প্রহরী আছেন।
খুরানিয়া জানিয়েছিলেন– পূর্ব কমান্ডে প্রায় চার হাজার মহিলা সীমান্ত প্রহরী আছেন। তাদের মূলত সেইসব গেটে রাখা হয়– যেখান দিয়ে কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে ভারতীয় এলাকায় মানুষ যান– সেখানে। ঘটনাচক্রে– ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের দৈর্ঘ্যও ৪১৪২.২৭ কিলোমিটার। একজন পুরুষ কনস্টেবল যদি বিমানবন্দর বা দেশের অন্য কোথাও কোনও নারীর ব্যাগ পরীক্ষা করতে চাইতেন– তাহলে তা নিয়ে বড়সড় বিতর্ক বেঁধে যেত। কিন্তু এটা তো সীমান্ত এলাকা।
ভুয়া মামলার ভয়
মেহেরুন্নিসা গাজি বলছিলেন– সবসময়ে একটা ভয়ের মধ্যে থাকতে হয় তাদের। আমাকে– আমার স্বামীকে কতবার ভয় দেখিয়েছে যে– নারী কেস– গরুর কেস বা ফেন্সি কেস দিয়ে ফাঁসিয়ে দেবে। আর যে ভয়টা আছে– সেটা সত্যি হয়ে নেমে এসেছিল দহরকান্দার বাসিন্দা তসলিমা বেগম সর্দারের জীবনে। তসলিমা বেগম সর্দার প্রায় ২৫ মাস মাদক পাচারের অভিযোগে জেলে থাকার পরে সম্প্রতি বেকসুর খালাস পেয়েছেন। ১৯ মে– ২০১৯ তারিখ সকালে কাজের জায়গায় যাচ্ছিলেন সরকারি চাকুরিরত তসলিমা বেগম সর্দার। সঙ্গে ছিলেন তার মেয়েও।
ফেন্সিডিল সাজিয়ে ছবি তুলতে চাইছিল
আমাকে আর মেয়েকে বিএসএফ দাঁড় করিয়ে বলল ব্যাগ চেক করব। আমরা কোনও আপত্তি করিনি– দেখুক চেক করে। তখন তারা বলে এখানে না– ক্যাম্পে গিয়ে চেক হবে। নিয়ে গেল ক্যাম্পে। আমাদের যেখানে বসিয়ে রেখেছিল– হঠাৎই দেখি সেখানে ফেন্সিডিল সাজাচ্ছে টেবিলে। বলা হল ছবি তুলব– কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন তসলিমা বেগম সর্দার। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই আপত্তি করেন ছবি তুলতে।
তার কথায়– আমি বলেছিলাম ওই জিনিস আমার সঙ্গে ছিল না– কিছুতেই ছবি তুলব না ওসব জিনিসের সঙ্গে। মেরে লাশ করে ফেললেও ছবি তোলাতে পারবে না তোমরা। খুব মারধর করল আমাদের। তারপরে থানায় নিয়ে গেল। বড়বাবু– মেজবাবু ছিলেন। তখন একটু সাহস এসেছে আমাদের– যে থানায় এনে তো আর মারতে পারবে না বিএসএফ। সব কথা খুলে বলেছিলাম যে– মিথ্যা কেসে ফাঁসানো হচ্ছে আমাদের।
কিন্তু ততক্ষণে মামলা রুজু হয়ে গেছে। জেল হাজতে যেতে হয়েছিল মা-মেয়েকে। এই সব হেনস্থার অভিযোগ সম্প্রতি উঠে এসেছিল পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভাতেও। বিএসএফের এক্তিয়ার বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আনা এক সরকারি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার সময়ে একাধিক বিধায়ক সীমান্তবাসীর নিয়মিত হেনস্থার কথা তুলে ধরেন।
প্রতিটা অভিযোগ খতিয়ে দেখা হয়ঃ বিএসএফ
সেই প্রসঙ্গে বিএসএফের পূর্ব কমান্ডের প্রধান ওয়াই বি খুরানিয়া বলছিলেন– আমরা প্রত্যেকটা অভিযোগ খুবই গুরুত্ব সহকারে খতিয়ে দেখি। প্রতিটা অভিযোগের ক্ষেত্রে কী কী ব্যবস্থা নিতে হবে– তার নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া রয়েছে। সেই প্রক্রিয়া কঠোরভাবে মেনে চলা হয়।
তবে এখানে একটা কথা স্পষ্ট করে বলা দরকার। এখানে বেশ কিছু কায়েমি স্বার্থ কাজ করে। তারা যেসব আন্তঃসীমান্ত বেআইনি কাজকর্ম করে– সেগুলো চালিয়ে যাওয়ার জন্যই নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয় অনেক সময়। এরকম অভিযোগ মাঝে মাঝেই পাই আমরা। তবে অভিযোগ পেলেই তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নিই– জানান খুরানিয়া। আইন তো আছে– কিন্তু যেখানে সব সময়ে মানুষকে ভয়ে থাকতে হয় যে– ভুয়া অভিযোগে বিএসএফ ফাঁসিয়ে দেবে। সেখানে কি কারও সাহস হয় জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে বিবাদ করার? আর সেজন্য সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোর অনেকেই জমি-বাড়ি বিক্রি করে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন।
যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে সীমান্ত ছাড়ছেন অনেকে
এদের অনেকের চাষের জমিই রয়েছে কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে। নিয়মিত তাদের চাষের কাজে যাওয়ার জন্য খাতায় নাম লিখিয়ে পরিচয়পত্র দেখিয়ে নির্দিষ্ট গেট পেরিয়ে যেতে হয়। আবার ফিরতেও হয় ঘড়ি ধরে।
কমল গাইন– দীপক মাঝিরা বলছিলেন– কাঁটাতারের ওদিকে যা জমি আছে– তা বিএসএফ কিনে নিক– আমাদের পুনর্বাসন দিক। অন্য জায়গায় চলে যাব আমরা।
গৃহবধূ লক্ষ্মী সরকার বলছিলেন– যে যন্ত্রণা আমরা পোহাচ্ছি– এবার এলাকা বাড়ছে– ভেতরের লোকরাও বুঝবে। বিএসএফের এলাকা জিরো লাইন থেকে ১৫ কিলোমিটার থেকে বাড়িয়ে ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত করায় সীমান্তবাসীর যে প্রতিক্রিয়া জানতে গিয়েছিলাম– লক্ষ্মী সরকারের এই একটা কথাতেই তা ফুটে উঠল।