২১ এপ্রিল ২০২৫, সোমবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বাংলা-অসমের মুসলিম মেয়ে পাচারের স্রোত এখন কাশ্মীরমুখী

বিপাশা চক্রবর্তী
  • আপডেট : ২৫ জানুয়ারী ২০২৩, বুধবার
  • / 7

আহমদ হাসান ইমরান: নারী পাচারের একটি ভিন্ন ধরন বেশকিছু বছর ধরে চলছে। আর চলছে পশ্চিমবাংলা ও অসম থেকে। এই দুই রাজ্যের অনুন্নত জেলাসমূহ এবং বাংলাভাষী মুসলিম মেয়েদের পাচার করে নিয়ে আসা হচ্ছে। তবে এবারে পাচারের গন্তব্য কিন্তু কাশ্মীর। কিন্তু বাংলায় গোপন হলেও কাশ্মীরে তা কিন্তু মোটেই নয়। সেখানে পশ্চিমবাংলা ও অসম থেকে প্রায় ২০০০-এরও বেশি কিলোমিটার দূরে কাশ্মীরের জম্মু, শ্রীনগর ও অন্য কিছু শহরেও বাংলা, অসমের মেয়েদের নিয়ে আসার এই চক্র প্রকাশ্যে দফতর খুলে বসেছে। আর এখান থেকেই তারা ঘরের কাজ কিংবা বিয়ের জন্য মেয়ে সরবরাহ করে থাকে।

অন্য প্রদেশেরও কিছু মেয়ে যে এই চক্রের কবলে পড়ে না, তা কিন্তু নয়। তবে তাদের সংখ্যা নেহাতই অল্প।

শ্রীনগরের একজন সমাজকর্মী আবদুল আহাদ বললেন, সাহেব এখন আমার বাড়িতেই একজন বাঙালি মেয়ে খাদিমা বা পরিচারিকার কাজ করে। তাকেও আমি এজেন্সি থেকেই নিয়েছি।

এজন্য আমাকে দিতে হয়েছে ৬০,০০০ টাকা। আর প্রতি মাসে দিতে হয় ৭০০০ টাকা করে বেতন। কিন্তু তার কতটা ওই মেয়েটি পায় আর কতটা এজেন্সির লোকেরা কেটে নেয় তা সঠিক বলতে পারব না। আমি যেহেতু একটু-আধটু বাংলা জানি, মেয়েটির সঙ্গে খানিকটা কথাও বলতে পারি।

আমি আবদুল আহাদ ও অন্য কয়েকজন কাশ্মীরির কাছ থেকে জানতে চাইলাম, কেন বাংলা ও অসমের গরিব মুসলিম মেয়েদের পাচারের এই স্রোত কাশ্মীরে এসে থামছে? তাঁরা বললেন, এর কয়েকটি কারণ রয়েছে। কাশ্মীরে আমাদের ঘরের গরিব, মেয়েরাও অন্য কারও বাড়িতে কাজ করতে অভ্যস্ত নয়। সেটাকে সামাজিকভাবে দোষনীয় মনে করা হয়।

ইদানীং শুধু মেয়ে নয়, অন্য বাড়িতে কাজ করার জন্য ছেলে পাওয়াও মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই পাচার এজেন্সিগুলি মেয়ে নিয়ে এসে ‘ঘরের কাজে মেয়ে চাই’- বলে বিজ্ঞাপন দিলে প্রচুর লোক তাদের কাছে হাজির হয়। প্রথমবার এজেন্সিকে দিতে হয় ৬০ হাজার থেকে ১ লক্ষ টাকা।

এই মেয়েরা তিন বছর কাজ করবে বলে এজেন্সিগুলি সাধারণত গ্যারান্টি দিয়ে থাকে। তিন বছর পর লাগলে আরও বেশি দামে নতুন পরিচারিকা কিংবা বিশেষ ক্ষেত্রে বর্তমান পরিচারিকারই চুক্তির নবায়ন হয়।

দ্বিতীয় কারণটি হল, কাশ্মীরে বাংলার মুসলিম মেয়েদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে আসা হয়। এখানে গ্রাম বা শহরতলির দিকে কিছু মেয়েকে বিবাহও দেওয়া হয়। বাঙালি মুসলিম মেয়েরা নাকি ভo এবং নম্র স্বভাবের হয়। আর তারা পুলিশ-কাছারি, বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ এসবের জন্য খুব একটা অযুহাত খোঁজে না। সব থেকে বড় কারণ হল, কাশ্মীরে যুবকদের বিয়ে করা খুবই ব্যয়সাপক্ষ।

সম্ভাব্য বধূকে প্রচুর পরিমাণে দেনমোহর, টাকা দিতে হয়। অনেক সময় মেয়েপক্ষ দাবি করে, মেয়ের নামে বরপক্ষকে জায়গা-জমি রেজিস্ট্রি করে দিতে হবে।

ফলে কাশ্মীরি মেয়ে বিয়ে করা মানে অনেকের কাছেই দেনার বোঝা। আর যদি তারা নিয়ে আসা বাঙালি কিংবা অসমিয়া মেয়েদের বিয়ের জন্য বেছে নেয়, তাহলে সংসারও হয়, আবার খরচও বেঁচে যায়। তাই এই প্রক্রিয়াতেও বেশকিছু বিয়ে হচ্ছে এখন কাশ্মীরে।

অনেক সময় যারা বয়স্ক কিংবা যাদের স্ত্রী মারা গেছে, তাদের বিয়ের জন্য কাশ্মীরি মেয়ে পাওয়া দুষ্কর। তারাও এজেন্সি থেকে বিয়ের জন্য বাঙালি বা অসমিয়া মুসলিম মেয়ে নিয়ে আসেন।

কিন্তু কথা হচ্ছে, এই মেয়েরা নিজেরা কি চান? অনেকের কাহিনি হচ্ছে, তারা বাংলা বা অসমে ফিরে যেতে খুবই উদ্গ্রীব থাকেন। তাঁদের আত্মীয়-স্বজনরাও সুদূর ২ হাজার, ৩ হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে দেখা করতে আসেন না। আর এলে কী ধরনের ব্যবহার পাবেন, সে-বিষয়ে তাঁরা নিশ্চিত নন। অনেক বাঙালি মুসলিম মেয়েই প্রতিদিন অশ্রুপাত করেন। অনেককে দিয়ে কঠোর পরিশ্রমও করানো হয়। এ ছাড়া পাচারকারী চক্র অন্য কোথাও তাদের উপর যৌন নিগ্রহ যে হয় না, তাও সঠিকভাবে বলা যায় না।

কিন্তু এর সমাধান কী? সমাধান হচ্ছে, এই মেয়ে পাচার রোখার জন্য সমাজে শিক্ষক, আলেম, ইমাম এবং ভালো এনজিওদের এগিয়ে আসতে হবে। যেসব দালাল বা কাশ্মীরে চলে যাওয়া মহিলা দালাল হিসেবে এখানে পাঠানো হয়, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। এ ছাড়া কাশ্মীর পুলিশ প্রশাসনকেও বিষয়টি অবহিত করা। অনেকেই সমাজসেবা করেন, পাচার রুখতে অনেকেই কাজ করছেন। কিন্তু কাশ্মীরে বাঙালি মুসলিম মেয়েদের পাচারের এই  স্রোত সম্পর্কে তারা নীরব।

Copyright © Puber Kalom All rights reserved.| Developed by eTech Builder

বাংলা-অসমের মুসলিম মেয়ে পাচারের স্রোত এখন কাশ্মীরমুখী

আপডেট : ২৫ জানুয়ারী ২০২৩, বুধবার

আহমদ হাসান ইমরান: নারী পাচারের একটি ভিন্ন ধরন বেশকিছু বছর ধরে চলছে। আর চলছে পশ্চিমবাংলা ও অসম থেকে। এই দুই রাজ্যের অনুন্নত জেলাসমূহ এবং বাংলাভাষী মুসলিম মেয়েদের পাচার করে নিয়ে আসা হচ্ছে। তবে এবারে পাচারের গন্তব্য কিন্তু কাশ্মীর। কিন্তু বাংলায় গোপন হলেও কাশ্মীরে তা কিন্তু মোটেই নয়। সেখানে পশ্চিমবাংলা ও অসম থেকে প্রায় ২০০০-এরও বেশি কিলোমিটার দূরে কাশ্মীরের জম্মু, শ্রীনগর ও অন্য কিছু শহরেও বাংলা, অসমের মেয়েদের নিয়ে আসার এই চক্র প্রকাশ্যে দফতর খুলে বসেছে। আর এখান থেকেই তারা ঘরের কাজ কিংবা বিয়ের জন্য মেয়ে সরবরাহ করে থাকে।

অন্য প্রদেশেরও কিছু মেয়ে যে এই চক্রের কবলে পড়ে না, তা কিন্তু নয়। তবে তাদের সংখ্যা নেহাতই অল্প।

শ্রীনগরের একজন সমাজকর্মী আবদুল আহাদ বললেন, সাহেব এখন আমার বাড়িতেই একজন বাঙালি মেয়ে খাদিমা বা পরিচারিকার কাজ করে। তাকেও আমি এজেন্সি থেকেই নিয়েছি।

এজন্য আমাকে দিতে হয়েছে ৬০,০০০ টাকা। আর প্রতি মাসে দিতে হয় ৭০০০ টাকা করে বেতন। কিন্তু তার কতটা ওই মেয়েটি পায় আর কতটা এজেন্সির লোকেরা কেটে নেয় তা সঠিক বলতে পারব না। আমি যেহেতু একটু-আধটু বাংলা জানি, মেয়েটির সঙ্গে খানিকটা কথাও বলতে পারি।

আমি আবদুল আহাদ ও অন্য কয়েকজন কাশ্মীরির কাছ থেকে জানতে চাইলাম, কেন বাংলা ও অসমের গরিব মুসলিম মেয়েদের পাচারের এই স্রোত কাশ্মীরে এসে থামছে? তাঁরা বললেন, এর কয়েকটি কারণ রয়েছে। কাশ্মীরে আমাদের ঘরের গরিব, মেয়েরাও অন্য কারও বাড়িতে কাজ করতে অভ্যস্ত নয়। সেটাকে সামাজিকভাবে দোষনীয় মনে করা হয়।

ইদানীং শুধু মেয়ে নয়, অন্য বাড়িতে কাজ করার জন্য ছেলে পাওয়াও মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই পাচার এজেন্সিগুলি মেয়ে নিয়ে এসে ‘ঘরের কাজে মেয়ে চাই’- বলে বিজ্ঞাপন দিলে প্রচুর লোক তাদের কাছে হাজির হয়। প্রথমবার এজেন্সিকে দিতে হয় ৬০ হাজার থেকে ১ লক্ষ টাকা।

এই মেয়েরা তিন বছর কাজ করবে বলে এজেন্সিগুলি সাধারণত গ্যারান্টি দিয়ে থাকে। তিন বছর পর লাগলে আরও বেশি দামে নতুন পরিচারিকা কিংবা বিশেষ ক্ষেত্রে বর্তমান পরিচারিকারই চুক্তির নবায়ন হয়।

দ্বিতীয় কারণটি হল, কাশ্মীরে বাংলার মুসলিম মেয়েদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে আসা হয়। এখানে গ্রাম বা শহরতলির দিকে কিছু মেয়েকে বিবাহও দেওয়া হয়। বাঙালি মুসলিম মেয়েরা নাকি ভo এবং নম্র স্বভাবের হয়। আর তারা পুলিশ-কাছারি, বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ এসবের জন্য খুব একটা অযুহাত খোঁজে না। সব থেকে বড় কারণ হল, কাশ্মীরে যুবকদের বিয়ে করা খুবই ব্যয়সাপক্ষ।

সম্ভাব্য বধূকে প্রচুর পরিমাণে দেনমোহর, টাকা দিতে হয়। অনেক সময় মেয়েপক্ষ দাবি করে, মেয়ের নামে বরপক্ষকে জায়গা-জমি রেজিস্ট্রি করে দিতে হবে।

ফলে কাশ্মীরি মেয়ে বিয়ে করা মানে অনেকের কাছেই দেনার বোঝা। আর যদি তারা নিয়ে আসা বাঙালি কিংবা অসমিয়া মেয়েদের বিয়ের জন্য বেছে নেয়, তাহলে সংসারও হয়, আবার খরচও বেঁচে যায়। তাই এই প্রক্রিয়াতেও বেশকিছু বিয়ে হচ্ছে এখন কাশ্মীরে।

অনেক সময় যারা বয়স্ক কিংবা যাদের স্ত্রী মারা গেছে, তাদের বিয়ের জন্য কাশ্মীরি মেয়ে পাওয়া দুষ্কর। তারাও এজেন্সি থেকে বিয়ের জন্য বাঙালি বা অসমিয়া মুসলিম মেয়ে নিয়ে আসেন।

কিন্তু কথা হচ্ছে, এই মেয়েরা নিজেরা কি চান? অনেকের কাহিনি হচ্ছে, তারা বাংলা বা অসমে ফিরে যেতে খুবই উদ্গ্রীব থাকেন। তাঁদের আত্মীয়-স্বজনরাও সুদূর ২ হাজার, ৩ হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে দেখা করতে আসেন না। আর এলে কী ধরনের ব্যবহার পাবেন, সে-বিষয়ে তাঁরা নিশ্চিত নন। অনেক বাঙালি মুসলিম মেয়েই প্রতিদিন অশ্রুপাত করেন। অনেককে দিয়ে কঠোর পরিশ্রমও করানো হয়। এ ছাড়া পাচারকারী চক্র অন্য কোথাও তাদের উপর যৌন নিগ্রহ যে হয় না, তাও সঠিকভাবে বলা যায় না।

কিন্তু এর সমাধান কী? সমাধান হচ্ছে, এই মেয়ে পাচার রোখার জন্য সমাজে শিক্ষক, আলেম, ইমাম এবং ভালো এনজিওদের এগিয়ে আসতে হবে। যেসব দালাল বা কাশ্মীরে চলে যাওয়া মহিলা দালাল হিসেবে এখানে পাঠানো হয়, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। এ ছাড়া কাশ্মীর পুলিশ প্রশাসনকেও বিষয়টি অবহিত করা। অনেকেই সমাজসেবা করেন, পাচার রুখতে অনেকেই কাজ করছেন। কিন্তু কাশ্মীরে বাঙালি মুসলিম মেয়েদের পাচারের এই  স্রোত সম্পর্কে তারা নীরব।