ইসলামে সামাজিক বন্ধনের গুরুত্ব

- আপডেট : ১৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, শনিবার
- / 21
মাওলানা মুহাম্মদ নূরুজ্জামানঃ ইসলাম মহান এক ধর্ম। এই ধর্মে সামাজিক দায়িত্ব ও দায়িত্ববোধকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। একজন মুসলিমের জীবন কেবল ব্যক্তিগত ইবাদাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং সমাজে ন্যায়বিচার, দয়া ও সহযোগিতার মাধ্যমে একটি শান্তিপূর্ণ এবং উন্নত সমাজ গড়ে তোলার জন্য প্রতিটি মুসলিমের উপর কিছু দায়িত্ব আরোপ করা হয়েছে। তার মানে সমাজে বসবাসরত অন্য ধর্মেও মানুষের প্রতিও ইসলাম ধর্ম মেনে চলা মানুষের দায়িত্ব আছে। পবিত্র কুরআন ও হাদিসে এই সামাজিক দায়িত্বের বিষয়টি বিভিন্নভাবে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে।
ইসলামে মানুষের প্রতি সহানুভূতি ও সাহায্যের দায়িত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ্তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন: ‘আর তোমরা সৎকর্ম ও পরহেযগারিতায় একে অপরের সহায়ক হও, কিন্তু পাপ ও সীমালঙ্ঘনে একে অপরের সহায়ক হয়ো না। আল্লাহ্কে ভয় করো, নিশ্চয়ই আল্লাহ্ কঠোর শাস্তিদাতা।’ (সূরা আল-মায়িদা, আয়াত: ২)
এই আয়াতে আল্লাহ্ তাঁর বান্দাহ্দের ন্যায় ও কল্যাণের কাজে সহযোগিতা করার নির্দেশ দিয়েছেন। একজন মুসলিমের দায়িত্ব হল, সমাজের কল্যাণে কাজ করা এবং পাপ থেকে দূরে থাকা। গরিব ও দুস্থদের সাহায্য করা: ইসলামে ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের উপর দরিদ্র ও অসহায়দের সাহায্য করার দায়িত্ব রয়েছে। ইসলামিক শিক্ষা অনুযায়ী, এটি একটি মৌলিক দায়িত্ব, যা মানবসম্প্রদায়ের সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং সম্প্রীতি বজায় রাখতে সাহায্য করে। আল্লাহ্ বলেন : ‘আর তাদের সম্পদে নির্দিষ্ট হক রয়েছে, ভিক্ষুক ও বঞ্চিতদের জন্য।’ (সূরা আদ-যারিয়াত, আয়াতঃ ১৯)
এই আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, প্রতিটি মুসলিমের উপর সমাজের দরিদ্র এবং অসহায়দের অধিকার রয়েছে। ইসলামে এই বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য যাকাত, সাদকা, ফিতরা ইত্যাদি দানের ব্যবস্থার মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখা হয়েছে। এবারে পারিবারিক ও আত্মীয়স্বজনের প্রতি দায়িত্ব কি দেখা যাক। পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালন করাও ইসলামের অন্যতম সামাজিক দায়িত্বের একটি অংশ। পিতামাতার প্রতি, সন্তান-সন্ততির প্রতি, এবং আত্মীয়স্বজনের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে পবিত্র কুরআন ও হাদিসে বিশেষভাবে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ্ বলেন : ‘আর তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তোমরা তাকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদাত করো না এবং পিতামাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করো। তাদের একজন অথবা উভয়েই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাঁদেরকে ‘উফ্’ বলো না এবং তাঁদেরকে ধমক দিও না, বরং তাদের সঙ্গে নম্র ও ভদ্রভাবে কথা বলো।’ (সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ২৩)
এই আয়াতটি আমাদের পিতামাতার প্রতি দায়িত্ব পালনের গুরুত্বকে নির্দেশ করে। তাঁদের প্রতি সম্মান, শ্রদ্ধা এবং যত্ন নেওয়া প্রতিটি সন্তানের কর্তব্য।
প্রতিবেশীর অধিকার কি? ইসলামে প্রতিবেশীর প্রতি সহানুভূতি ও দায়িত্ব পালনকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বলে আমরা দেখতে পাই। হাদিসে রাসূলুল্লাহ্ সা. বলেন : তিনি ঈমানদার হতে পারে না, যে তার প্রতিবেশীকে ক্ষুধার্ত অবস্থায় রেখে নিজে তৃপ্ত থাকে।’ (সহিহ্ বুখারী) এই হাদিসের মাধ্যমে সমাজে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে এবং মানবিক দায়িত্ব পালন করার একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে। মুসলিম সমাজে প্রতিবেশীর সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করা একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বলে বিবেচিত হয়।
♦ ন্যায় ও সৎকর্মে দায়িত্ববোধ
ইসলামে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার উপর অত্যন্ত জোর দেওয়া হয়েছে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ বলেছেন : ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্ ন্যায়বিচার, সদাচার ও আত্মীয়স্বজনের প্রতি সদয় আচরণ করতে নির্দেশ দেন এবং অশ্লীলতা, মন্দ কাজ ও অবাধ্যতা থেকে নিষেধ করেন। তিনি তোমাদের উপদেশ দেন, যাতে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করো। (সূরা আন-নাহল, আয়াত ; ৯০) এটি একটি সমাজে ন্যায়বিচার এবং সৎকর্মের গুরুত্ব নির্দেশ করে। একজন মুসলিমের দায়িত্ব হল, প্রতিটি কাজ ন্যায়ের ভিত্তিতে সম্পন্ন করা এবং অশ্লীলতা ও অবাধ্যতা থেকে দূরে থাকা।
♦ হাদিসে সামাজিক দায়িত্বের শিক্ষা
রাসূলুল্লাহ্ সা. বিভিন্ন হাদিসের মাধ্যমে মুসলিমদের সামাজিক দায়িত্ব পালন সম্পর্কে সচেতন করেছেন। তিনি (সা.) বলেন: ‘সর্বোত্তম ব্যক্তি সে, যে মানুষের জন্য সবচেয়ে বেশি কল্যাণকারী।’ (আল-মুআত্তা) এই হাদিস থেকে বোঝা যায় যে, একজন প্রকৃত মুসলিমের দায়িত্ব হল সমাজের কল্যাণে কাজ করা। নিজের প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি অন্যদের প্রয়োজনও মেটানো উচিত।
♦ সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় দায়িত্ব
ইসলামের সামাজিক দায়িত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী, কোনও মুমিন কখনও সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে না। আল্লাহ্ বলেন : ‘আর পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের পছন্দ করেন না।’ (সূরা আল-বাকারাহ্, আয়াতঃ ২০৫) এই আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, ইসলামে সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য প্রতিটি মানুষের দায়িত্ব রয়েছে। ইসলামে সামাজিক দায়িত্ব ও দায়িত্ববোধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পবিত্র কুরআন ও হাদিসে এর গুরুত্ব নিয়ে ব্যাপক আলোচনা রয়েছে। একজন মুসলিমের দায়িত্ব হল, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা, গরিব ও অসহায়দের সাহায্য করা, আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীর অধিকার রক্ষা করা এবং সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। হোক তার প্রতিবেশী অন্য ধর্মের কেউ। সেই ক্ষেত্রে তার দায়িত্ব একটুখানিও কমে না। আল্লাহ্ আমাদেরকে এই সুমহান দায়িত্ব পালনে তাওফিক দিন।