মাওলানা আবদুল মান্নানঃ আমরা সকলেই প্রত্যাশা করি, আমাদের রিযকে প্রশস্ততা ও বরকত বৃদ্ধি হোক। অথচ এ সম্বন্ধে আল-কুরআনের নির্দেশনা কি? তা আমরা অবগত নই। কেবলমাত্র পার্থিব উপায় উপকরণ সম্বল করে কষ্ট-ক্লেশ ও পরিশ্রম করে রিযিকের অনুসন্ধানে ব্যাপৃত থাকি। জীবনোপকরণ অনুসন্ধানে পার্থিব প্রচেষ্টার সঙ্গে সঙ্গে যদি আমরা পবিত্র আল-কুরআন ও হাদীস শরীফের নির্দেশনা অনুসরণ করি, তাহলে ‘ইনশাআল্লাহ্’ আমরা আমাদের রিযিককে আশানুরূপ প্রশস্ততা ও বরকত লাভ করতে পারি। রিযিকে প্রশস্ততা, প্রাচুর্য ও বরকত লাভের উপায় হিসেবে আল-কুরআনের নির্দেশনা কী? তা আমরা জানার চেষ্টা করব।
→ অর্থাৎ অধিক পরিমাণে আল্লাহ্তায়ালার নিকটে নিজ গুনাহের জন্য ক্ষমা-প্রার্থনা করা। হযরত নূহ্ আ. তাঁর কওম বা সম্প্রদায়কে বলেছিলেন , ‘তোমাদের প্রতিপালকের নিকট ক্ষমা-প্রার্থনা করো। তিনি তো মহাক্ষমাশীল! তিনি তোমাদের জন্য প্রচুর বৃষ্টিপাত করবেন। তিনি তোমাদের সমৃদ্ধ করবেন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে এবং তোমাদের জন্য স্থাপন করবেন উদ্যান ও নদী-নালা প্রবাহিত করবেন।’ (সূরা নূহ্, আয়াত: ১০-১২)
→ তাফসীরকারকগণ উপরোক্ত আয়াত এবং সূরা ‘হুদ’-এর ০৩ ও ২৫ নম্বর আয়াতের বিশদ ব্যাখ্যায় বর্ণনা করেছেন যে, পবিত্র কুরআন মজীদের উপরোক্ত বাণী এই কথা প্রমাণ করে যে, গুনাহের জন্য ক্ষমা-প্রার্থনা করা রিযিক বৃদ্ধির ও বরকত লাভের অন্যতম উপায়। নবী করীম সা. বলেন, ‘সেই ব্যক্তি অধিক পরিমাণে আল্লাহর নিকট তার গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে, আল্লাহ্তায়ালা তার দুঃখ-কষ্ট লাঘব করেছেন। তার সকল সমস্যার সমাধানের জন্য উপায় উদ্ভাবন করেন এবং তাকে সেই উৎস থেকে রিযিক্ (জীবনোপকরণ) দান করেন, সেই বিষয়ে তার কোনও ধারণাই ছিল না।’ (মুসনাদে আহমাদ, আবু দাউদ, নাসায়ী, ইবনে মাযাহ)
→ অর্থাৎ আল্লাহ্কে ভয় করে জীবনযাপন করা। আল্লাহ্ এরশাদ করেন, ‘‘যে কেউ আল্লাহ্কে ভয় করে চলে আল্লাহ্ তার পথ করেছেন এবং তাকে তার ধারণাতীত উৎস হতে জীবিকা দান করেন’’। (সূরা তালাক, আয়াত: ২-৩)
→ ইমাম গাজ্জালী রহ. বলেছেন, আল্লাহর প্রতি নির্ভর করার অর্থ হল মনে-প্রাণে তাঁর প্রতি নির্ভরশীল হওয়া, যেভাবে তাঁর প্রতি নির্ভর করার জন্য দাবি করা হয়েছে। আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর নির্ভর করে তার জন্য আল্লাহ্ই যথেষ্ট, আল্লাহ্ তার ইচ্ছাপূরণ করেন।’ (সূরা তালাক, আয়াতঃ ৩) নবী করীম সা. বলেন, ‘যদি তুমি আল্লাহর প্রতি সেই পরিমাণ নির্ভর করতে পারো, যে পরিমাণ নির্ভর করার কথা তিনি বলেছেন, তাহলে তিনি তোমাকে সেই উৎস থেকে রিযিক দান করবেন, যেমনভাবে তিনি পক্ষীকুলকে রিযিক দান করেন।
→ পক্ষীকুল খালি পেটে ভোরবেলায় বাসা ছেড়ে বের হয়ে যায় আর পরিতৃপ্ত হয়ে সন্ধ্যাকালে বাসায় ফিরে আসা’।’ (মুসনাদে আহমাদ, তিরমিযী, ইবনে মাযাহ) এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, রিযিক অনুসন্ধানে চেষ্টা করা তাওয়াক্কুল বিরোধী নয়। আল্লাহর ইবাদাতে সময় ব্যয় করা- এর অর্থ এই নয় যে, আমাদের দিন-রাত মসজিদে অবস্থান করতে হবে। বরং অর্থ এই যে, আল্লাহর আহকাম (বিধি-নিষেধ) পালন করে জীবনযাপন করতে হবে। নবী করীম সা. বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্ বলেছেন, হে আদম সন্তান! আমার ইবাদাতের জন্য সময় ব্যয় কর, তাহলে আমি তোমার অন্তরকে সম্পদের প্রাচুর্যে ভরে দেব এবং লোকেদের থেকে তোমাকে মুখাপেক্ষীহীন করে দেব।’ (মুসনাদে আহমাদ, তিরমিযী, ইবনে মাযাহ)
→ ইসলামী জীবনবিধানে আত্মীয়দের হক্ আদায় করা ও তাদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। নবী করীম সা. ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি তার রিযিকে প্রশস্ততা চায়, তার উচিৎ সে যেন আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করে।’ (বুখারী) আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করলে রিযিক বৃদ্ধি পায় এই সম্বন্ধে হাদীস গ্রন্থ সমূহে অসংখ্য হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
→ আল্লাহ্পাক ইরশাদ করেছেন, ‘হে নবী! এদেরকে বলুন, আমার আল্লাহ্ তাঁর বান্দাহদের মধ্যে হতে যাকে চান তাকে প্রশস্ত রিযিক্ দান করেন। আর যাকে ইচ্ছা পরিমিত পরিমাণ দেন। তোমরা যা কিছু খরচ করো তার স্থলে তিনি তোমাদেরকে আরও দেন। তিনি সব রিযিক্ দাতাদের মধ্যে উত্তর রিযিক দাতা।’ (সূরা সাবা, আয়াতঃ ৩৯) তাফসীরকারকগণ উপরোক্ত আয়াত শরীফের ব্যাখ্যায় বর্ণনা করেছেন যে,আল্লাহর পথে খরচ করার প্রতিদান লোকেরা দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতে প্রাপ্ত হবে। আর এই দুনিয়ায় আল্লাহ্ তার রিযিকে প্রাচুর্য ও বরকত দান করেন। নবী করীম সা. ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ্ বলেন, হে আদম সন্তান! তুমি আল্লাহর পথে খরচ করো। আমি তোমার উপর খরচ করব’।’ (মুসলিম)
→ বার বার হজ ও উমরাহ আদায় করলে রিযিক্ বৃদ্ধি পায়। নবী করীম সা. বলেন, ‘বার বার হজ ও উমরাহ আদায় কর। নিশ্চয়ই এই দু’টি আসল দারিদ্রতা ও গোনাহকে এমনভাবে দূরীভূত করে, যেমনভাবে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড লৌহের মরিচাকে নিঃশেষ করে দেয়।’ (তিরমিযী, নাসায়ী)