১৮ এপ্রিল ২০২৫, শুক্রবার, ৪ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

মুখের ভাষা বুকের রুধির

বিপাশা চক্রবর্তী
  • আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২৩, মঙ্গলবার
  • / 8

মুখের ভাষা বুকের রুধির১৯৭১  সাল। তখন চলছে বাংলাদেশ স্বাধীন করার সংগ্রাম। পালিয়ে আসা শরণার্থীর আশ্রয় নিয়েছেন বিভিন্ন স্কুলে। তার মধ্যে ছিল জলপাইগুড়ি জেলার বানারহাট উচ্চ বিদ্যালয়ও। আর এই স্কুলের বার্ষিক পত্রিকা ছিল ‘সঞ্চয়ন’। বাংলাদেশের চলমান মুক্তি সংগ্রামের উপর তখনই এই নিবন্ধটি লিখেছিলেন আহমদ হাসান (ইমরান) আজ থেকে ৫১ বছর আগে। তিনি ‘সঞ্চয়ন’ পত্রিকার ছাত্র-সম্পাদক। নিবন্ধটি আজও কিন্তু সমান অর্থবহ। -বিভাগীয় সম্পাদক




 ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো

‘একুশে ফেব্রুয়ারী’

আমি কি ভুলতে পারি!

না, ভায়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারীকে কবি ভুলতে পারেন না। ভুলতে পারেন না সেই সালাম-বরকত-রফিক-জব্বারকে— যাঁরা বুকের রক্ত দিয়ে রেখেছেন মুখের ভাষা, লিখেছেন এক নতুন ইতিহাস। তাঁদের লাল, তাজা রক্তের উষ্ণতায় সেদিন ‘বন্দিনী রাজকন্যার’ মত ঘুম ভেঙ্গেছিল পূর্ব্ব-বাংলার জনসাধারণের। একুশে ফেব্রুয়ারীর নবজাগৃতির সাড়া দুলিয়ে দিয়েছিল সারা পূর্ব-বাংলাকে, জেগে উঠেছিল মানুষ সুপ্ত অধিকার প্রতিষ্ঠার বজ্রশপন নিয়ে। রক্তের নদীতে স্নান করে সৃষ্টি হয়েছিল এক সংগ্রামী জাতির।

কিন্তু এপারের আমরা কি করেছি! এসব দেখেশুনে ভাবের জোয়ারে, আবেগের বেগে স্থির থাকতে না পেরে আমরা শুধু কিছু সভাসমিতি করে আর গরম গরম বক্তৃতা দিয়েই ক্ষান্ত। নইলে স্বাধীনতার এতো বছর পর আজও কেন সমস্ত সরকারী কাজ হয় বিদেশী এক ভাষার মাধ্যমে, বাংলায় গাড়ীর নম্বর লেখলে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা হাজির হয় আর পরিভাষার অভাবের মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে বিজ্ঞান শিক্ষা দেওয়া হয় ইংরাজীর মাধ্যমে? উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাতো আজও অবহেলিত। আমরা যদি কৃতঘ্নই না হবো তবে কি আমরা ভুলে যেতাম ১৯৬১ সালের ‘উনিশে মে’র রক্তরাঙা দিনটিকে, ভুলে যেতাম বঙ্গভাষা-জননীর বেদীমূলে উৎসর্গীকৃত সেই একাদশ শহীদকে

১৯শে মে’র কথা পরে, এখন ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারীর দিকেই দৃষ্টি ফেরানো যাক। পাকিস্তান তখন সবে স্বাধীন হয়েছে। পূর্ব-বাংলার জনগণ স্বাধীনতার আস্বাদ পেয়ে আনন্দে অধীর। পরাধীনতার নাগপাশ থেকে তারা মুক্ত হয়েছে। এবার তারা খুঁজে পাবে নিজেদের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ সাধনের পথ।

কিন্তু হায়রে! ওদিকে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকবৃন্দ আর তাদের কিছু হুকুম-বরদার বাঙ্গালী ভৃত্য সুজলা-সুফলা পূর্ব-বাংলাকে দেখতে পেয়েছে শোষণের উর্ব্বর ক্ষেত্র হিসাবে। আর একটি দায়িত্ব তারা নিজেরাই কাঁধে তুলে নিল- পূর্ব-বাংলার মুসলমানদের প্রকৃত মুসলমান করে তুলতে হবে, তাদের শরীর থেকে দূর করতে হবে হিন্দুয়ানীর সমস্ত দুর্গন্ধ। অর্থনৈতিক শোষণ তো আগেই শুরু হয়েছিল এবার খড়্গাঘাত নেমে এল বাংলা ভাষার উপর।

শাসকচক্র ভাবল, মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে জনগণকে বোবা করে দিলে অন্যান্য গণতান্ত্রিক অধিকার গুলিকে হরণ করতেও আর বিশেষ বেগ পেতে হবে না। তাছাড়া, উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে, চাকরীর বাজারে বাংলাভাষীরা নিশ্চয়ই উর্দু ভাষীদের সঙ্গে প্রতিযোগীতায় পেরে উঠবে না। ফলে সবক্ষেত্রেই পশ্চিম পাকিস্তানীদের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। সুতরাং হুকুম হল, উর্দুই হবে পাকিস্থানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। আশ্চর্য! পাকিস্তানের অধিবাসীদের অধিকাংশের (শতকরা ৫৫ ভাগের) মাতৃভাষা বাংলা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষাও নাকি হতে পারবে না। বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল পূর্ব্ব-বাংলার ছাত্রসমাজ আর বুদ্ধিজীবির দল। অলক্ষ্যে প্রস্তুত হতে লাগল সংগ্রামী জনতা ‘আমার ভাষা, তোমার ভাষা, মায়ের ভাষা- বাংলা ভাষা’। এর অধিকার ক্ষুণ্ণ হতে দেব না কিছুতেই।

বাংলার মানুষ এর প্রথম আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানাল ১৯৪৮ সালের ২৪শে মার্চ। পাকিস্তানের স্রষ্টা ‘কায়দে আজম’ জিন্না এসেছেন পূর্ব-বাংলায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্ত্তন অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে যখন জিন্না বললেন- ‘প্রিয় ছাত্রগণ, আমি তোমাদের জানাতে চাই যে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। কারণ ইসলামের আদর্শ ও ঐতিহ্য একমাত্র উর্দু ভাষায়ই সঠিক প্রকাশ পেয়েছে-, ওমনি কয়েকজন ছাত্র উঠে দাঁড়িয়ে দৃঢ়কণ্ঠে তার প্রতিবাদ জানাল, না, না-, এ হতে পারে না। উর্দুর সঙ্গে বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা করতে হবে।’

কী! এত বড় দুঃসাহস, জাতির পিতা জিন্নার কথার উপর কথা! আচ্ছা, এর উচিত উত্তরই পূর্ব-বাংলার মানুষকে দেওয়া হবে। অপমানিত জিন্না হল ত্যাগ করে চলে গেলেন।

চক্রান্ত শুরু হল, সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল ভাষা আন্দোলনের এক রক্তক্ষয়ী অধ্যায়। পূর্ব-বাংলার শতকরা ৯৯ জন যেখানে বাংলা ভাষায় কথা বলেন সেখানে পূর্ব-পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী, মুসলিম লীগ নেতা খাজা নাজীমুদ্দিন সদর্পে ঘোষণা করলেন–

“I am sure nobody excepting a handful of persons in East-Bengal demand that Bengali should be the official language of Pakistan.”

প্রতিবাদে ফেটে পড়ল পূর্ব-বাংলার ছাত্র সমাজ আর শিক্ষিত জনসাধারণ। গড়ে উঠল ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম সমিতি। আন্দোলন চলতে লাগল পুরোদমে- ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।’

বুদ্ধিজীবিদের এক সমাবেশে ডক্টর শহীদুল্লা সকলকে স্মরণ করিয়ে দিলেন ষোড়শ শতাব্দীতে লেখা বাংলার কবি আবদুল হাকিমের সেই কবিতাটি-

‘যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।

সে সব কাহার জন্ম নির্ণএ না জানি ॥

দেশীভাষা বিদ্যা যার মনে না যুয়াএ ।

নিজদেশ তেয়াগী কেন বিদেশে না জাএ ॥

মাতা পিতামহো ক্রমে বঙ্গেত বসতি।

দেশী ভাষা উপদেশ মন হিতয়তি।।

ইতিমধ্যে ক্রমাগত আন্দোলন ও ক্রমবর্ধমান বিক্ষোভের চাপে প্রাদেশিক সরকারের সুর কিঞ্চিং নরম হয়েছে। জনগণকে শান্ত করার অভিপ্রায়ে প্রাদেশিক সরকার বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করার জন্য কেন্দ্রের কাছে সুপারিশ করার সিদ্ধান্ত নিলেন।

কিন্তু, হঠাৎ ১৯৫২ সালের ২৬শে জানুয়ারী নাজিমুদ্দিন ঘোষণা করলেন– না, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। সেই অনুযায়ী কাজও শুরু হল। সর্বত্র শিক্ষা তালিকায় শীর্ষস্থান অধিকার করল উর্দু। উর্দু শিক্ষা হল বাধ্যতামূলক। পূর্ব-বাংলায় আগত অবাঙ্গালী মুসলমানরা বাংলা ও বাঙালীকে উপনিবেশিক দৃষ্টিতে দেখা শুরু করল। বাঙ্গালী নিজের ঘরে পরবাসী হল।

বিক্ষোভ ধূমায়িত হতে লাগল সারা বাংলায়। ছাত্রদের উদ্যোগে একটি সর্বদলীয় বৈঠকে সংগ্রামের নানাপন্থা নিয়ে আলোচনা হল। স্থির হলো ২১ ফেব্রুয়ারী বৃহস্পতিবার বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা দাবী করে সারা পূর্ব-বাংলায় এক ব্যাপক হরতাল অনুষ্ঠিত হবে। মুসলিম লীগ সরকারও হরতালকে ব্যর্থ করার জন্য তৈরী হল। তারা ১৪৪ ধারা জারী করে ২১শে ফেব্রুয়ারী ঢাকা জেলার সর্বত্র সভা ও শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন। রাজনৈতিক নেতারা ১৪৪ ধারা ভংগ করার ঝুঁকি নিতে চাইলেন না। কিন্তু, ছাত্র নেতারা আর একটি সর্বদলীয় বৈঠকে ঘোষণা করলেন যে সমস্ত প্রকার প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তারা ২১ ফেব্রুয়ারী ১৪৪ ধারা ভংগ করবেন। ‘ভাষার প্রশ্নে কোন আপস নয়।’ এখন থেকে ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব এসে গেল ছাত্রদের হাতে। এরপর থেকে পূর্ব-বাংলায় সমস্ত গণতান্ত্রিক আন্দোলনেই ছাত্রদের এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।)

২১ ফেব্রুয়ারী বেলা দশটার সময় ছাত্ররা ১০ জনের এক একটি দল করে আইন অমান্য করতে শুরু করলেন। কিছু সংখ্যক ছাত্রকে গ্রেপ্তার করার পর পুলিশ লাঠি চালিয়ে বাকীদের ছত্রভঙ্গ করে দিল। কিন্তু, বেলা দুটোর সময় আবার যখন ছাত্ররা বিপুল সংখ্যায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে এসে পুলিশ বেষ্টনী ভেঙ্গে ফেলার উপক্রম করল, তখন পুলিশ আর ধৈর্য্য রাখতে পারল না। ঘোষণা করা হল ছাত্ররা এখনি ছত্রভঙ্গ না হলে গুলী করা হবে। কিন্তু, মৃত্যুঞ্জয়ী ছাত্ররা তখন অকুতোভয়। হঠাৎ, পুলিশ সেই নিরস্ত্র ছাত্রদের উপর গুলিচালনা আরম্ভ করল— বেপরোয়া, এলোপাথাড়ি। দেখতে দেখতে ১৯ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। শহীদ হলেন আবদুল জব্বার, আবদুল বরকত ও রফিক উদ্দীন আহমেদ। তিনজনই ছাত্র। শোক সাগরে নিমজ্জিত হল সারা বাংলা। পরদিন পূব আকাশে আবার নূতন সূর্য উঠল এক জ্বলন্ত জিজ্ঞাসা চিহ্ন হয়ে। বাঙ্গালী কি ভয়ে পিছিয়ে যাবে? শহীদের রক্তদান কি তবে ব্যর্থ হবে?

না, এবার এগিয়ে এল বাংলার আপামর জনসাধারণ। শহীদের লাশের সামনে দাঁড়িয়ে তারা শপথ নিল?

‘আমাদের ভাই ওরা, আমাদের লোক

আমাদের করে গেছে এক

একটি জ্বলন্ত অঙ্গার,

সার্থক করে যেতে হবে

রক্তদানের সেই

অফুরন্ত স্নেহ ভালবাসা।’

এতদিন, আন্দোলন সীমাবদ্ধ ছিল প্রধানতঃ ছাত্র ও বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে— এবার তা ছড়িয়ে পড়ল সবার মধ্যে, সব জায়গায়। আন্দোলনের শরীক হলেন কৃষক-মজুর, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-দরিদ্র, হিন্দু-মুসলমান সবাই। লক্ষ কন্ঠে আওয়াজ উঠল ‘জান দেব’ জবান দেব না। ভাষার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত অন্যায়, অত্যাচার, শোষণের বিরুদ্ধেও জনগণ বিরামহীন সংগ্রাম ঘোষণা করলেন

‘জনতার সংগ্রাম চলবেই

আমাদের সংগ্রাম চলবেই।।

হতমানে অপমানে নয়— সুখে সম্মানে

বাঁচবার অধিকার কাড়তে

দাস্যের নির্মোক ছাড়তে

অগণিত মানুষের প্রাণপণ যুদ্ধ

চলবেই চলবেই,

আমাদের সংগ্রাম চলবেই।’

জনগণ আজ কিছুতেই ভীত নয়, কোন আত্মত্যাগেই নয় কুণ্ঠিত। তাদের একমাত্র লক্ষ্য বিজয়ী হওয়া ।

‘দিয়েছি তো শাস্তি আরও দেবো স্বস্তি

দিয়েছি তো সংগ্রাম আরো দেবো অস্থি

প্রয়োজন হলে দেবো একনদী রক্ত,

হোক না পথের বাধা প্রস্তর শক্ত,

অবিরাম যাত্রার চিরসংঘর্ষে

একদিন সে পাহাড় টলবেই।

চলবেই চলবেই

আমাদের সংগ্রাম চলবেই।’

হ্যাঁ, পাহাড় টলেছিল। গণবিস্ফোরণের চাপ সহ্য করতে না পেরে শাসকচক্র বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা রূপে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। বাংলা ভাষা সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল গৌরবের আসনে। শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাঙ্গালী ফিরে পেল তার ভাষাকে। ২১ ফেব্রুয়ারীর তাৎপর্য্য এতেই শেষ নয়। আজ যে বাংলাদেশে (পূর্ব বাংলায়) হিন্দু-মুসলমান এক হয়ে স্বাধীনতার যুদ্ধে, গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার যুদ্ধে লিপ্ত, তার শুরু হয়েছিল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী। ২১ ফেব্রুয়ারীর আলোকে বাঙ্গালী নিজেকে চিনেছিল নূতন করে। বুঝেছিল বাঙ্গালী হিসাবে তার এক স্বতন্ত্র অস্তিত্ব, স্বতন্ত্র অর্থনীতি, স্বতন্ত্র সংস্কৃতি আছে যা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। একে রক্ষা করতে না পারলে জাতি হিসাবে তাঁর অস্তিত্ব হবে বিপন্ন— সে হয়ে পড়বে পশ্চিম-পাকিস্তানী ঔপনিবেশিকতাবাদের সহজ শিকার। ২১ ফেব্রুয়ারীর আবেগ ও ঐক্য থেকে পরবর্ত্তীকালে জনসাধারণের মধ্যে যে ব্যাপক রাজনৈতিক চেতনা, গণতান্ত্রিক অধিকার-বোধ ও নিজ সংস্কৃতি-প্রীতি এসেছে তা ঐতিহাসিক। ঊনবিংশ শতকের বাংলাদেশে যেমন নূতন সাংস্কৃতিক জাগরণ ও নব-জীবনবোধ এসেছিল, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারীও পূর্ব-বাংলায় তেমন এক নূতন রেনেশাঁ এনে দিয়েছে। বরকত-সালাম-রফিক জব্বারের লহু (রক্ত) সিক্ত বাংলার মাটিতে সেদিন গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবোধের যে বীজ রোপিত হয়েছিল, আজ এত বছর পর সে বীজ প্রকাণ্ড মহীরূহ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম তারই ক্রমপ্রকাশ।

প্রার্থনা করি, জয় হোক বাংলা দেশের, জয় হোক তার স্বাধীনতা সংগ্রামের। জয় বাংলা।

বানারহাট স্কুলের ছাত্র বন্ধুরা, তোমরা ২১ ফেব্রুয়ারী ও ১৯শে মে’র পুণ্যদিনে এইসব শহীদদের স্মরণ করতে ভুলো না। ভুলো না সেই আদর্শকে যে আদর্শের জন্য শহীদরা প্রাণ দিয়েছেন। আমাদের পশ্চিম বাংলায় বাংলা ভাষা এখনও তার যথাযোগ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত। বাংলা ভাষাকে যথোচিত মর্য্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব আমাদেরই— এই পবিত্র কর্তব্যকার্যে ছাত্র সমাজকেই অগ্রণী হতে হবে। বাংলা আজ বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষা। পৃথিবীর আর কোন জাতি তাঁদের ভাষাকে রক্ষা করার জন্য এত রক্ত দিয়েছে বলে আমার জানা নেই। বাংলা ভাষা বহু শহীদের আত্মদানের সমুজ্জ্বল। এখানেই অন্যান্য ভাষার সঙ্গে গরিমায় বাংলা ভাষার স্বাতন্ত্র।

সবশেষে আবার স্মরণ করি সেই শহীদদের— যারা মুখের ভাষার জন্য নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠিত হন নি।

হে অমৃতের বর পুত্ররা

‘যতদিন দুই হাত থাকবে সবল

যতদিন রক্তের তাপ থাকবে

সত্য থাকবে স্থির অন্তরে

যতদিন জড়াবে না

জিহ্বা ততদিন’।

—ততদিন তোমরা বাঙ্গালীর জাতির অন্তরে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।

(বানান অপরিবর্তিত)

Copyright © Puber Kalom All rights reserved.| Developed by eTech Builder

মুখের ভাষা বুকের রুধির

আপডেট : ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২৩, মঙ্গলবার

মুখের ভাষা বুকের রুধির১৯৭১  সাল। তখন চলছে বাংলাদেশ স্বাধীন করার সংগ্রাম। পালিয়ে আসা শরণার্থীর আশ্রয় নিয়েছেন বিভিন্ন স্কুলে। তার মধ্যে ছিল জলপাইগুড়ি জেলার বানারহাট উচ্চ বিদ্যালয়ও। আর এই স্কুলের বার্ষিক পত্রিকা ছিল ‘সঞ্চয়ন’। বাংলাদেশের চলমান মুক্তি সংগ্রামের উপর তখনই এই নিবন্ধটি লিখেছিলেন আহমদ হাসান (ইমরান) আজ থেকে ৫১ বছর আগে। তিনি ‘সঞ্চয়ন’ পত্রিকার ছাত্র-সম্পাদক। নিবন্ধটি আজও কিন্তু সমান অর্থবহ। -বিভাগীয় সম্পাদক




 ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো

‘একুশে ফেব্রুয়ারী’

আমি কি ভুলতে পারি!

না, ভায়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারীকে কবি ভুলতে পারেন না। ভুলতে পারেন না সেই সালাম-বরকত-রফিক-জব্বারকে— যাঁরা বুকের রক্ত দিয়ে রেখেছেন মুখের ভাষা, লিখেছেন এক নতুন ইতিহাস। তাঁদের লাল, তাজা রক্তের উষ্ণতায় সেদিন ‘বন্দিনী রাজকন্যার’ মত ঘুম ভেঙ্গেছিল পূর্ব্ব-বাংলার জনসাধারণের। একুশে ফেব্রুয়ারীর নবজাগৃতির সাড়া দুলিয়ে দিয়েছিল সারা পূর্ব-বাংলাকে, জেগে উঠেছিল মানুষ সুপ্ত অধিকার প্রতিষ্ঠার বজ্রশপন নিয়ে। রক্তের নদীতে স্নান করে সৃষ্টি হয়েছিল এক সংগ্রামী জাতির।

কিন্তু এপারের আমরা কি করেছি! এসব দেখেশুনে ভাবের জোয়ারে, আবেগের বেগে স্থির থাকতে না পেরে আমরা শুধু কিছু সভাসমিতি করে আর গরম গরম বক্তৃতা দিয়েই ক্ষান্ত। নইলে স্বাধীনতার এতো বছর পর আজও কেন সমস্ত সরকারী কাজ হয় বিদেশী এক ভাষার মাধ্যমে, বাংলায় গাড়ীর নম্বর লেখলে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা হাজির হয় আর পরিভাষার অভাবের মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে বিজ্ঞান শিক্ষা দেওয়া হয় ইংরাজীর মাধ্যমে? উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাতো আজও অবহেলিত। আমরা যদি কৃতঘ্নই না হবো তবে কি আমরা ভুলে যেতাম ১৯৬১ সালের ‘উনিশে মে’র রক্তরাঙা দিনটিকে, ভুলে যেতাম বঙ্গভাষা-জননীর বেদীমূলে উৎসর্গীকৃত সেই একাদশ শহীদকে

১৯শে মে’র কথা পরে, এখন ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারীর দিকেই দৃষ্টি ফেরানো যাক। পাকিস্তান তখন সবে স্বাধীন হয়েছে। পূর্ব-বাংলার জনগণ স্বাধীনতার আস্বাদ পেয়ে আনন্দে অধীর। পরাধীনতার নাগপাশ থেকে তারা মুক্ত হয়েছে। এবার তারা খুঁজে পাবে নিজেদের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ সাধনের পথ।

কিন্তু হায়রে! ওদিকে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকবৃন্দ আর তাদের কিছু হুকুম-বরদার বাঙ্গালী ভৃত্য সুজলা-সুফলা পূর্ব-বাংলাকে দেখতে পেয়েছে শোষণের উর্ব্বর ক্ষেত্র হিসাবে। আর একটি দায়িত্ব তারা নিজেরাই কাঁধে তুলে নিল- পূর্ব-বাংলার মুসলমানদের প্রকৃত মুসলমান করে তুলতে হবে, তাদের শরীর থেকে দূর করতে হবে হিন্দুয়ানীর সমস্ত দুর্গন্ধ। অর্থনৈতিক শোষণ তো আগেই শুরু হয়েছিল এবার খড়্গাঘাত নেমে এল বাংলা ভাষার উপর।

শাসকচক্র ভাবল, মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে জনগণকে বোবা করে দিলে অন্যান্য গণতান্ত্রিক অধিকার গুলিকে হরণ করতেও আর বিশেষ বেগ পেতে হবে না। তাছাড়া, উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে, চাকরীর বাজারে বাংলাভাষীরা নিশ্চয়ই উর্দু ভাষীদের সঙ্গে প্রতিযোগীতায় পেরে উঠবে না। ফলে সবক্ষেত্রেই পশ্চিম পাকিস্তানীদের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। সুতরাং হুকুম হল, উর্দুই হবে পাকিস্থানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। আশ্চর্য! পাকিস্তানের অধিবাসীদের অধিকাংশের (শতকরা ৫৫ ভাগের) মাতৃভাষা বাংলা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষাও নাকি হতে পারবে না। বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল পূর্ব্ব-বাংলার ছাত্রসমাজ আর বুদ্ধিজীবির দল। অলক্ষ্যে প্রস্তুত হতে লাগল সংগ্রামী জনতা ‘আমার ভাষা, তোমার ভাষা, মায়ের ভাষা- বাংলা ভাষা’। এর অধিকার ক্ষুণ্ণ হতে দেব না কিছুতেই।

বাংলার মানুষ এর প্রথম আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানাল ১৯৪৮ সালের ২৪শে মার্চ। পাকিস্তানের স্রষ্টা ‘কায়দে আজম’ জিন্না এসেছেন পূর্ব-বাংলায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্ত্তন অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে যখন জিন্না বললেন- ‘প্রিয় ছাত্রগণ, আমি তোমাদের জানাতে চাই যে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। কারণ ইসলামের আদর্শ ও ঐতিহ্য একমাত্র উর্দু ভাষায়ই সঠিক প্রকাশ পেয়েছে-, ওমনি কয়েকজন ছাত্র উঠে দাঁড়িয়ে দৃঢ়কণ্ঠে তার প্রতিবাদ জানাল, না, না-, এ হতে পারে না। উর্দুর সঙ্গে বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা করতে হবে।’

কী! এত বড় দুঃসাহস, জাতির পিতা জিন্নার কথার উপর কথা! আচ্ছা, এর উচিত উত্তরই পূর্ব-বাংলার মানুষকে দেওয়া হবে। অপমানিত জিন্না হল ত্যাগ করে চলে গেলেন।

চক্রান্ত শুরু হল, সঙ্গে সঙ্গে শুরু হল ভাষা আন্দোলনের এক রক্তক্ষয়ী অধ্যায়। পূর্ব-বাংলার শতকরা ৯৯ জন যেখানে বাংলা ভাষায় কথা বলেন সেখানে পূর্ব-পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী, মুসলিম লীগ নেতা খাজা নাজীমুদ্দিন সদর্পে ঘোষণা করলেন–

“I am sure nobody excepting a handful of persons in East-Bengal demand that Bengali should be the official language of Pakistan.”

প্রতিবাদে ফেটে পড়ল পূর্ব-বাংলার ছাত্র সমাজ আর শিক্ষিত জনসাধারণ। গড়ে উঠল ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম সমিতি। আন্দোলন চলতে লাগল পুরোদমে- ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।’

বুদ্ধিজীবিদের এক সমাবেশে ডক্টর শহীদুল্লা সকলকে স্মরণ করিয়ে দিলেন ষোড়শ শতাব্দীতে লেখা বাংলার কবি আবদুল হাকিমের সেই কবিতাটি-

‘যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।

সে সব কাহার জন্ম নির্ণএ না জানি ॥

দেশীভাষা বিদ্যা যার মনে না যুয়াএ ।

নিজদেশ তেয়াগী কেন বিদেশে না জাএ ॥

মাতা পিতামহো ক্রমে বঙ্গেত বসতি।

দেশী ভাষা উপদেশ মন হিতয়তি।।

ইতিমধ্যে ক্রমাগত আন্দোলন ও ক্রমবর্ধমান বিক্ষোভের চাপে প্রাদেশিক সরকারের সুর কিঞ্চিং নরম হয়েছে। জনগণকে শান্ত করার অভিপ্রায়ে প্রাদেশিক সরকার বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করার জন্য কেন্দ্রের কাছে সুপারিশ করার সিদ্ধান্ত নিলেন।

কিন্তু, হঠাৎ ১৯৫২ সালের ২৬শে জানুয়ারী নাজিমুদ্দিন ঘোষণা করলেন– না, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। সেই অনুযায়ী কাজও শুরু হল। সর্বত্র শিক্ষা তালিকায় শীর্ষস্থান অধিকার করল উর্দু। উর্দু শিক্ষা হল বাধ্যতামূলক। পূর্ব-বাংলায় আগত অবাঙ্গালী মুসলমানরা বাংলা ও বাঙালীকে উপনিবেশিক দৃষ্টিতে দেখা শুরু করল। বাঙ্গালী নিজের ঘরে পরবাসী হল।

বিক্ষোভ ধূমায়িত হতে লাগল সারা বাংলায়। ছাত্রদের উদ্যোগে একটি সর্বদলীয় বৈঠকে সংগ্রামের নানাপন্থা নিয়ে আলোচনা হল। স্থির হলো ২১ ফেব্রুয়ারী বৃহস্পতিবার বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা দাবী করে সারা পূর্ব-বাংলায় এক ব্যাপক হরতাল অনুষ্ঠিত হবে। মুসলিম লীগ সরকারও হরতালকে ব্যর্থ করার জন্য তৈরী হল। তারা ১৪৪ ধারা জারী করে ২১শে ফেব্রুয়ারী ঢাকা জেলার সর্বত্র সভা ও শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন। রাজনৈতিক নেতারা ১৪৪ ধারা ভংগ করার ঝুঁকি নিতে চাইলেন না। কিন্তু, ছাত্র নেতারা আর একটি সর্বদলীয় বৈঠকে ঘোষণা করলেন যে সমস্ত প্রকার প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তারা ২১ ফেব্রুয়ারী ১৪৪ ধারা ভংগ করবেন। ‘ভাষার প্রশ্নে কোন আপস নয়।’ এখন থেকে ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব এসে গেল ছাত্রদের হাতে। এরপর থেকে পূর্ব-বাংলায় সমস্ত গণতান্ত্রিক আন্দোলনেই ছাত্রদের এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।)

২১ ফেব্রুয়ারী বেলা দশটার সময় ছাত্ররা ১০ জনের এক একটি দল করে আইন অমান্য করতে শুরু করলেন। কিছু সংখ্যক ছাত্রকে গ্রেপ্তার করার পর পুলিশ লাঠি চালিয়ে বাকীদের ছত্রভঙ্গ করে দিল। কিন্তু, বেলা দুটোর সময় আবার যখন ছাত্ররা বিপুল সংখ্যায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে এসে পুলিশ বেষ্টনী ভেঙ্গে ফেলার উপক্রম করল, তখন পুলিশ আর ধৈর্য্য রাখতে পারল না। ঘোষণা করা হল ছাত্ররা এখনি ছত্রভঙ্গ না হলে গুলী করা হবে। কিন্তু, মৃত্যুঞ্জয়ী ছাত্ররা তখন অকুতোভয়। হঠাৎ, পুলিশ সেই নিরস্ত্র ছাত্রদের উপর গুলিচালনা আরম্ভ করল— বেপরোয়া, এলোপাথাড়ি। দেখতে দেখতে ১৯ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। শহীদ হলেন আবদুল জব্বার, আবদুল বরকত ও রফিক উদ্দীন আহমেদ। তিনজনই ছাত্র। শোক সাগরে নিমজ্জিত হল সারা বাংলা। পরদিন পূব আকাশে আবার নূতন সূর্য উঠল এক জ্বলন্ত জিজ্ঞাসা চিহ্ন হয়ে। বাঙ্গালী কি ভয়ে পিছিয়ে যাবে? শহীদের রক্তদান কি তবে ব্যর্থ হবে?

না, এবার এগিয়ে এল বাংলার আপামর জনসাধারণ। শহীদের লাশের সামনে দাঁড়িয়ে তারা শপথ নিল?

‘আমাদের ভাই ওরা, আমাদের লোক

আমাদের করে গেছে এক

একটি জ্বলন্ত অঙ্গার,

সার্থক করে যেতে হবে

রক্তদানের সেই

অফুরন্ত স্নেহ ভালবাসা।’

এতদিন, আন্দোলন সীমাবদ্ধ ছিল প্রধানতঃ ছাত্র ও বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে— এবার তা ছড়িয়ে পড়ল সবার মধ্যে, সব জায়গায়। আন্দোলনের শরীক হলেন কৃষক-মজুর, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-দরিদ্র, হিন্দু-মুসলমান সবাই। লক্ষ কন্ঠে আওয়াজ উঠল ‘জান দেব’ জবান দেব না। ভাষার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত অন্যায়, অত্যাচার, শোষণের বিরুদ্ধেও জনগণ বিরামহীন সংগ্রাম ঘোষণা করলেন

‘জনতার সংগ্রাম চলবেই

আমাদের সংগ্রাম চলবেই।।

হতমানে অপমানে নয়— সুখে সম্মানে

বাঁচবার অধিকার কাড়তে

দাস্যের নির্মোক ছাড়তে

অগণিত মানুষের প্রাণপণ যুদ্ধ

চলবেই চলবেই,

আমাদের সংগ্রাম চলবেই।’

জনগণ আজ কিছুতেই ভীত নয়, কোন আত্মত্যাগেই নয় কুণ্ঠিত। তাদের একমাত্র লক্ষ্য বিজয়ী হওয়া ।

‘দিয়েছি তো শাস্তি আরও দেবো স্বস্তি

দিয়েছি তো সংগ্রাম আরো দেবো অস্থি

প্রয়োজন হলে দেবো একনদী রক্ত,

হোক না পথের বাধা প্রস্তর শক্ত,

অবিরাম যাত্রার চিরসংঘর্ষে

একদিন সে পাহাড় টলবেই।

চলবেই চলবেই

আমাদের সংগ্রাম চলবেই।’

হ্যাঁ, পাহাড় টলেছিল। গণবিস্ফোরণের চাপ সহ্য করতে না পেরে শাসকচক্র বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা রূপে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। বাংলা ভাষা সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল গৌরবের আসনে। শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাঙ্গালী ফিরে পেল তার ভাষাকে। ২১ ফেব্রুয়ারীর তাৎপর্য্য এতেই শেষ নয়। আজ যে বাংলাদেশে (পূর্ব বাংলায়) হিন্দু-মুসলমান এক হয়ে স্বাধীনতার যুদ্ধে, গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার যুদ্ধে লিপ্ত, তার শুরু হয়েছিল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী। ২১ ফেব্রুয়ারীর আলোকে বাঙ্গালী নিজেকে চিনেছিল নূতন করে। বুঝেছিল বাঙ্গালী হিসাবে তার এক স্বতন্ত্র অস্তিত্ব, স্বতন্ত্র অর্থনীতি, স্বতন্ত্র সংস্কৃতি আছে যা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। একে রক্ষা করতে না পারলে জাতি হিসাবে তাঁর অস্তিত্ব হবে বিপন্ন— সে হয়ে পড়বে পশ্চিম-পাকিস্তানী ঔপনিবেশিকতাবাদের সহজ শিকার। ২১ ফেব্রুয়ারীর আবেগ ও ঐক্য থেকে পরবর্ত্তীকালে জনসাধারণের মধ্যে যে ব্যাপক রাজনৈতিক চেতনা, গণতান্ত্রিক অধিকার-বোধ ও নিজ সংস্কৃতি-প্রীতি এসেছে তা ঐতিহাসিক। ঊনবিংশ শতকের বাংলাদেশে যেমন নূতন সাংস্কৃতিক জাগরণ ও নব-জীবনবোধ এসেছিল, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারীও পূর্ব-বাংলায় তেমন এক নূতন রেনেশাঁ এনে দিয়েছে। বরকত-সালাম-রফিক জব্বারের লহু (রক্ত) সিক্ত বাংলার মাটিতে সেদিন গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবোধের যে বীজ রোপিত হয়েছিল, আজ এত বছর পর সে বীজ প্রকাণ্ড মহীরূহ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম তারই ক্রমপ্রকাশ।

প্রার্থনা করি, জয় হোক বাংলা দেশের, জয় হোক তার স্বাধীনতা সংগ্রামের। জয় বাংলা।

বানারহাট স্কুলের ছাত্র বন্ধুরা, তোমরা ২১ ফেব্রুয়ারী ও ১৯শে মে’র পুণ্যদিনে এইসব শহীদদের স্মরণ করতে ভুলো না। ভুলো না সেই আদর্শকে যে আদর্শের জন্য শহীদরা প্রাণ দিয়েছেন। আমাদের পশ্চিম বাংলায় বাংলা ভাষা এখনও তার যথাযোগ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত। বাংলা ভাষাকে যথোচিত মর্য্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব আমাদেরই— এই পবিত্র কর্তব্যকার্যে ছাত্র সমাজকেই অগ্রণী হতে হবে। বাংলা আজ বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষা। পৃথিবীর আর কোন জাতি তাঁদের ভাষাকে রক্ষা করার জন্য এত রক্ত দিয়েছে বলে আমার জানা নেই। বাংলা ভাষা বহু শহীদের আত্মদানের সমুজ্জ্বল। এখানেই অন্যান্য ভাষার সঙ্গে গরিমায় বাংলা ভাষার স্বাতন্ত্র।

সবশেষে আবার স্মরণ করি সেই শহীদদের— যারা মুখের ভাষার জন্য নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠিত হন নি।

হে অমৃতের বর পুত্ররা

‘যতদিন দুই হাত থাকবে সবল

যতদিন রক্তের তাপ থাকবে

সত্য থাকবে স্থির অন্তরে

যতদিন জড়াবে না

জিহ্বা ততদিন’।

—ততদিন তোমরা বাঙ্গালীর জাতির অন্তরে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।

(বানান অপরিবর্তিত)