১৯ এপ্রিল ২০২৫, শনিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

পবিত্র ঈদ-উল-আযহার তাৎপর্য ও শিক্ষা

সামিমা এহসানা
  • আপডেট : ২৮ জুন ২০২৩, বুধবার
  • / 9

মাওলানা মুহাম্মদ নুরুজ্জামানঃ প্রতিটি জাতির জীবনে এমন কিছু দিন আছে যাকে তারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। যে দিনটির আগমন প্রত্যেকটি মানুষের জন্য আনন্দ উৎসবের বার্তা বয়ে নিয়ে আসে। এই উৎসব-আনন্দে তাদের নিজ নিজ ইতিহাস-ঐতিহ্য, বিশ্বাস, মানসিকতা প্রভৃতি মূর্ত হয়ে ওঠে। তবে ঈদ উৎসবের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য আরও সুদূরপ্রসারী ও ব্যাপক। এই প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে— ‘(হে রাসূল!) আপনি বলে দিন যে, আমার নামায, আমার সব বন্দেগী, আমার জীবন এবং আমার মরণ সবই আল্লাহ্তায়ালার জন্য— যিনি সমগ্র বিশ্বের প্রতিপালক এবং যাঁর কোনও অংশীদার নেই।’

মুমিন-জীবনে অফুরন্ত খুশির বার্তা নিয়ে হাজির হয় দুইটি দিন— ঈদ-উল-ফিতর ও ঈদ-উল-আযহা। ধনী-গরিব, ছেলে-বুড়ো, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব মুসলমানের জীবনে ঈদ হাজির করে আনন্দের বন্যা। এমনকি অন্যান্য ধর্মের মানুষকেও ঈদের আনন্দ স্পর্শ করে। মানবিক সাম্য, ত্যাগ ও সহমর্মিতার বিস্ময়কর ও অপরূপ আলোকপ্রভা ঈদের উৎসবে প্রকাশিত হয়, যা ইসলামের মহত্ত্ব ও সর্বজনীনতার প্রতীক।

আরবি ‘আওদ’ শধ থেকে ‘ঈদ’ শধের উৎপত্তি। এটি সাধারণত দু’টি অর্থে ব্যবহৃত হয়— ১. আনন্দ, খুশি। এই অর্থটি পবিত্র কুরআনে ব্যবহৃত হয়েছে এবং হাদিসেও এসেছে। ২. অপর অর্থ বার বার হাজির হওয়া, ফিরে আসা প্রভৃতি । ঈদ প্রতি বছর আনন্দের পয়গাম নিয়ে হাজির হয়। অপরদিকে আরবি ‘আযহা’ শব্দের অর্থ— ত্যাগ স্বীকার, কুরবানি প্রভৃতি। ঈদ-উল-আযহা আরবি বাক্যাংশ। এর অর্থ হল ‘ত্যাগের উৎসব’। এই উৎসবের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল ত্যাগ করা। এই দিনটিতে ফযরের নামাযের পর ঈদগাহে গিয়ে দুই রাকায়াত ঈদ-উল-আযহার নামায আদায় ও অব্যবহিত পরে স্ব-স্ব আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী আল্লাহ্-র নামে পশু কুরবানি করে। ঈদ-উল-আযহায় আল্লাহ্-র রাহে ত্যাগ ও কুরবানির চেতনা ভাস্বর হয়ে ওঠে। পশু জবেহ করার মাধ্যমে আল্লাহ্-র নৈকট্য লাভের প্রচেষ্টা মানব ইতিহাসের জন্মলগ্ন থেকেই চলে আসছে।

মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহীম আ. আল্লাহ্-র আদেশ পালনার্থে নিজ পুত্র হযরত ইসমাঈল আ.-কে কুরবানি করতে প্রস্তুত হয়েছিলেন। এই ঘটনায় কুরবানির গুরুত্ব ও তাৎপর্য আরও বেড়ে যায়। এরই ধারাবাহিকতায় প্রভুপ্রেমে প্রাণ উৎসর্গ করা একটা পুণ্যময় ইবাদাত বলে বিবেচিত হয়ে আসছে।

কুরবানি এমন একটি মর্যাদাকর বিষয়, যাতে রয়েছে একাধারে আত্মগঠন এবং সুস্থ সমাজ গঠনের সর্বশ্রেষ্ঠ উপাদানাবলি। ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের মধ্যে কোনও ধরনের পার্থক্য নেই। পার্থক্য রয়েছে শুধু আল্লাহ্ভীতির ক্ষেত্রে, সৎ ও অসতের মধ্যে, ঈমানদার ও বেঈমানের মধ্যে। এই দৃষ্টিকোণ থেকেই তাৎপর্য অনুমেয়। ঈদের শিক্ষা হল— সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও একাত্মবোধের মাধ্যমে আনন্দ উপভোগ এবং পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতার সম্প্রসারণ। সমাজের গরিব, দুস্থ ও অভাবী মানুষও যাতে এই মহানন্দে শামিল হতে পারে, সেজন্য ইসলাম নির্দেশনা দিয়েছে। ধনী-গরিবের একাকার হয়ে যাওয়ার এই ব্যবস্থা সত্যিই বিরল। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, জাতীয়, আন্তর্জাতিক, পারলৌকিক সব ক্ষেত্রেই ঈদের দাবি পরিব্যাপ্ত। ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য থেকে বিচ্যুত না হয়ে সামাজিকতা এবং মানবতাবোধকে সমুন্নত করাই ঈদের মূল তাৎপর্য। এক কথায় বলা যায়, ঈদ ইসলামের সার্বজনীনতা এবং বিশ্বজনীনতাকে সমুন্নত করেছে। এর মধ্যে ইসলামের মূল সৌন্দর্য তথা বিশ্ব-ভ্রাতৃত্বের উপাদান নিহিত রয়েছে।

ঈদ-উল-আযহার শিক্ষা কী? এর সবচেয়ে বড় শিক্ষা হল কুরবানি বা ত্যাগ করা। ত্যাগের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হওয়া। এই ত্যাগ জীবনের নানা স্তরে বিদ্যমান। আমরা ছোট ছোট ত্যাগের মাধ্যমে বৃহত্তর ত্যাগের জন্য প্রস্তুত হতে পারি। আপন বা নিজ জিনিসের মায়া ত্যাগ করা সহজ কাজ নয়। এই কাজটি সহজ করার শিক্ষাই হলো ঈদ-উল-আযহার আসল শিক্ষা।

যাদের সামর্থ আছে তারা এই ঈদে পশু কুরবানি করবেন। সহিহ্ভাবে এই কাজটি সম্পন্ন হলে হাদিসে বলা হয়েছে  ‘কুরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই তা আল্লাহ্-র কাছে কবুল হয়ে যায়।’ একই সময়ে পবিত্র মক্কাশরীফে হয়ে থাকে পবিত্র হজ। যাঁরা হজ পালন করেন তাঁরা হজের পাশাপাশি কুরবানি করে দ্বিগুণ সাওয়াব হাসিলের সুযোগ লাভ করেন। আর যারা গরিব-দুখি কুরবানি করতে পারে না, তারা কুরবানিকৃত পশুর গোশত পেয়ে থাকেন— এটা তাদের হক। এর মধ্য দিয়ে গরিব মানুষও ভালো খাবার সুযোগ পায়। আল্লাহ্ সবাইকে ঈদ-উল-আযহা পালন করা, সহিহ্ নিয়তে কুরবানিও পবিত্র হজ পালন করার তাওফিক দিন। আমিন!

Copyright © Puber Kalom All rights reserved.| Developed by eTech Builder

পবিত্র ঈদ-উল-আযহার তাৎপর্য ও শিক্ষা

আপডেট : ২৮ জুন ২০২৩, বুধবার

মাওলানা মুহাম্মদ নুরুজ্জামানঃ প্রতিটি জাতির জীবনে এমন কিছু দিন আছে যাকে তারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। যে দিনটির আগমন প্রত্যেকটি মানুষের জন্য আনন্দ উৎসবের বার্তা বয়ে নিয়ে আসে। এই উৎসব-আনন্দে তাদের নিজ নিজ ইতিহাস-ঐতিহ্য, বিশ্বাস, মানসিকতা প্রভৃতি মূর্ত হয়ে ওঠে। তবে ঈদ উৎসবের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য আরও সুদূরপ্রসারী ও ব্যাপক। এই প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে— ‘(হে রাসূল!) আপনি বলে দিন যে, আমার নামায, আমার সব বন্দেগী, আমার জীবন এবং আমার মরণ সবই আল্লাহ্তায়ালার জন্য— যিনি সমগ্র বিশ্বের প্রতিপালক এবং যাঁর কোনও অংশীদার নেই।’

মুমিন-জীবনে অফুরন্ত খুশির বার্তা নিয়ে হাজির হয় দুইটি দিন— ঈদ-উল-ফিতর ও ঈদ-উল-আযহা। ধনী-গরিব, ছেলে-বুড়ো, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব মুসলমানের জীবনে ঈদ হাজির করে আনন্দের বন্যা। এমনকি অন্যান্য ধর্মের মানুষকেও ঈদের আনন্দ স্পর্শ করে। মানবিক সাম্য, ত্যাগ ও সহমর্মিতার বিস্ময়কর ও অপরূপ আলোকপ্রভা ঈদের উৎসবে প্রকাশিত হয়, যা ইসলামের মহত্ত্ব ও সর্বজনীনতার প্রতীক।

আরবি ‘আওদ’ শধ থেকে ‘ঈদ’ শধের উৎপত্তি। এটি সাধারণত দু’টি অর্থে ব্যবহৃত হয়— ১. আনন্দ, খুশি। এই অর্থটি পবিত্র কুরআনে ব্যবহৃত হয়েছে এবং হাদিসেও এসেছে। ২. অপর অর্থ বার বার হাজির হওয়া, ফিরে আসা প্রভৃতি । ঈদ প্রতি বছর আনন্দের পয়গাম নিয়ে হাজির হয়। অপরদিকে আরবি ‘আযহা’ শব্দের অর্থ— ত্যাগ স্বীকার, কুরবানি প্রভৃতি। ঈদ-উল-আযহা আরবি বাক্যাংশ। এর অর্থ হল ‘ত্যাগের উৎসব’। এই উৎসবের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল ত্যাগ করা। এই দিনটিতে ফযরের নামাযের পর ঈদগাহে গিয়ে দুই রাকায়াত ঈদ-উল-আযহার নামায আদায় ও অব্যবহিত পরে স্ব-স্ব আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী আল্লাহ্-র নামে পশু কুরবানি করে। ঈদ-উল-আযহায় আল্লাহ্-র রাহে ত্যাগ ও কুরবানির চেতনা ভাস্বর হয়ে ওঠে। পশু জবেহ করার মাধ্যমে আল্লাহ্-র নৈকট্য লাভের প্রচেষ্টা মানব ইতিহাসের জন্মলগ্ন থেকেই চলে আসছে।

মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহীম আ. আল্লাহ্-র আদেশ পালনার্থে নিজ পুত্র হযরত ইসমাঈল আ.-কে কুরবানি করতে প্রস্তুত হয়েছিলেন। এই ঘটনায় কুরবানির গুরুত্ব ও তাৎপর্য আরও বেড়ে যায়। এরই ধারাবাহিকতায় প্রভুপ্রেমে প্রাণ উৎসর্গ করা একটা পুণ্যময় ইবাদাত বলে বিবেচিত হয়ে আসছে।

কুরবানি এমন একটি মর্যাদাকর বিষয়, যাতে রয়েছে একাধারে আত্মগঠন এবং সুস্থ সমাজ গঠনের সর্বশ্রেষ্ঠ উপাদানাবলি। ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের মধ্যে কোনও ধরনের পার্থক্য নেই। পার্থক্য রয়েছে শুধু আল্লাহ্ভীতির ক্ষেত্রে, সৎ ও অসতের মধ্যে, ঈমানদার ও বেঈমানের মধ্যে। এই দৃষ্টিকোণ থেকেই তাৎপর্য অনুমেয়। ঈদের শিক্ষা হল— সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও একাত্মবোধের মাধ্যমে আনন্দ উপভোগ এবং পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতার সম্প্রসারণ। সমাজের গরিব, দুস্থ ও অভাবী মানুষও যাতে এই মহানন্দে শামিল হতে পারে, সেজন্য ইসলাম নির্দেশনা দিয়েছে। ধনী-গরিবের একাকার হয়ে যাওয়ার এই ব্যবস্থা সত্যিই বিরল। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, জাতীয়, আন্তর্জাতিক, পারলৌকিক সব ক্ষেত্রেই ঈদের দাবি পরিব্যাপ্ত। ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য থেকে বিচ্যুত না হয়ে সামাজিকতা এবং মানবতাবোধকে সমুন্নত করাই ঈদের মূল তাৎপর্য। এক কথায় বলা যায়, ঈদ ইসলামের সার্বজনীনতা এবং বিশ্বজনীনতাকে সমুন্নত করেছে। এর মধ্যে ইসলামের মূল সৌন্দর্য তথা বিশ্ব-ভ্রাতৃত্বের উপাদান নিহিত রয়েছে।

ঈদ-উল-আযহার শিক্ষা কী? এর সবচেয়ে বড় শিক্ষা হল কুরবানি বা ত্যাগ করা। ত্যাগের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হওয়া। এই ত্যাগ জীবনের নানা স্তরে বিদ্যমান। আমরা ছোট ছোট ত্যাগের মাধ্যমে বৃহত্তর ত্যাগের জন্য প্রস্তুত হতে পারি। আপন বা নিজ জিনিসের মায়া ত্যাগ করা সহজ কাজ নয়। এই কাজটি সহজ করার শিক্ষাই হলো ঈদ-উল-আযহার আসল শিক্ষা।

যাদের সামর্থ আছে তারা এই ঈদে পশু কুরবানি করবেন। সহিহ্ভাবে এই কাজটি সম্পন্ন হলে হাদিসে বলা হয়েছে  ‘কুরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই তা আল্লাহ্-র কাছে কবুল হয়ে যায়।’ একই সময়ে পবিত্র মক্কাশরীফে হয়ে থাকে পবিত্র হজ। যাঁরা হজ পালন করেন তাঁরা হজের পাশাপাশি কুরবানি করে দ্বিগুণ সাওয়াব হাসিলের সুযোগ লাভ করেন। আর যারা গরিব-দুখি কুরবানি করতে পারে না, তারা কুরবানিকৃত পশুর গোশত পেয়ে থাকেন— এটা তাদের হক। এর মধ্য দিয়ে গরিব মানুষও ভালো খাবার সুযোগ পায়। আল্লাহ্ সবাইকে ঈদ-উল-আযহা পালন করা, সহিহ্ নিয়তে কুরবানিও পবিত্র হজ পালন করার তাওফিক দিন। আমিন!