ড. জামাল আল বাদাবী মিশরে জন্মগ্রহণ করেন। আমেরিকার ব্লুমিংটনে ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি ও ডক্টরেট করেন বিজা অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ওপর। বর্তমান বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামি চিন্তাবিদ। ইসলামের প্রচার ও দাওয়াতের কাজে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। ‘ইসলামিক টিচিং কোর্স’ তাঁর ধারাবাহিক বক্তব্যের সংকলন। এ গ্রন্থ থেকে উল্লে’যোগ্য বিষয়গুলি ‘পুবের কলম’ পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হচ্ছে
(ক) ঐতিহাসিক গুরুত্ব : রমযান মাস ইসলামী ক্যালেন্ডারের বা আরবি সন হিজরির নবম মাস। এ মাসেই রাসূল সা.-এর ওপর হেরা গুহায় প্রথম পবিত্র কুরআন নাযিল হয়েছিল। এর গুরুত্ব শুধু মুসলমানদের জন্যই নয়। বরং গোটা ইতিহাসে সব নবীর উম্মতের ওপরই এই মাসে রোযা ফরয ছিল। কারণ এ মাসেই আল্লাহ্ মানবজাতির সর্বশেষ এবং সম্পূর্ণ জীবন বিধান পবিত্র কুরআন প্রণয়ন করেন, যা অনেক নবীর মিশন শেষে মুহাম্মদ সা.-এর মাধ্যমে মানবজাতিকে দেওয়া হয়। পবিত্র কুরআন সত্য-মিথ্যার পার্থক্য সূচনাকারী আল্ ফুরকান।
(খ) আধ্যাত্মিক ও নৈতিক গুরুত্ব : ইসলাম এই শিক্ষাই দেয় যে, আল্লাহ্ সব মানুষের অতি নিকটে, বিশেষভাবে যারা আল্লাহের আদেশ পালন করে এবং তাঁর আলোকেই জীবনকে পুনর্বিন্যস্ত করে। রমযানে আল্লাহ্র হুকুমে রোযা পালনের মাধ্যমে আল্লাহর আদেশ পালন করে তাঁর নৈকট্য হাসিল করা যায়। তাই বিশ্বাসীদের জন্য এ মাস অত্যন্ত প্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ্র আদেশে দৈহিক ইচ্ছা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক ও নৈতিক পরিশুদ্ধি অর্জন করে।
রমযান মাসে মুসলমানরা ফজরের ওয়াক্তের শুরু থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও স্বামী-স্ত্রী মিলন থেকে বিরত থাকে, পুরো মাস এ নিয়মে চলতে হয়। এ মাসে সূর্যাস্তের পর থেকে পরদিন ফজরের পূর্ব পর্যন্ত সময়ে পানাহার ও স্বামী-স্ত্রী মিলনে নিষেধ নেই। অবশ্য এ সময় ভুরিভোজ নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এই রোযার মাসে রোযা রাখার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে আত্মনিয়ন্ত্রণ আসে।
রমযান ইসলামি ক্যালেন্ডারের একটি মাস যা চন্দ্র বছর বা হিজরী সনের মাস। চন্দ্র বছর সৌর বছরের চেয়ে ৯ থেকে ১০ দিন কম হয়। এজন্যে প্রতি বছর রমযান মাস পূর্বের বছরের চেয়ে ১০-১১ দিন আগে আসে। এতে সুবিধা এই যে মুসলমানরা সব ঋতুতেই রোযার অভিজ্ঞতা লাভ করে।
ইসলামী আইন বা শরীয়াহ্ সব দেশের সব যুগের জন্য সহজবোধ্য করে তৈরি করা হয়েছে। মুসলিম আইনবিদরা বলেন, ‘যেসব দেশে মাসের পর মাস সূর্য দেখা যায় না বা মাসের পর মাস রাত থাকে সেখানকার মুসলমানরা নিচের যে-কোনও একটি ব্যবস্থা নেবে —
ক. সেই দেশের নিকটবর্তী যে দেশে দিনরাত যথা নিয়মে হয় সেখানকার সময় অনুসারে তারা রোযা রাখবে।
‘. মক্কার সেহেরী ইফতারের অনুসরণ করে রোযা রাখবে।
বয়োঃপ্রাপ্ত বালেগ সকল মুসলমানের জন্য রোযা ফরজ। এটা বাঞ্ছনীয় যে শিশুদের মাঝে ছোটবেলা থেকেই রোযার অভ্যাস গড়ে তোলা। এতে তাদের মধ্যে রোযার জন্য প্রয়োজনীয় ত্যাগ ও শৃঙ্খলাবোধ জন্মাবে। তবে তাদের এ কাজে চাপ প্রয়োগ করা যাবে না। সাধারণত মুসলিম শিশুরা বড়দের সঙ্গে উঠে সেহেরী খেতে ও রোযা রাখতে খুবব উৎসাহ বোধ করে। এজন্য অনেক পিতামাতা শিশুদের সেহেরী খাওয়ায় এবং সংক্ষিপ্ত রোযা শেষে দুপুরেই ইফতার করিয়ে দেয়। এটা এক্ষেত্রে ভালো যে এভাবে ধীরে ধীরে বাচ্চাদের মধ্যে রোযার অভ্যাস জন্মে।
কয়েকটি ক্ষেত্রে রোযা থেকে সাময়িক বা পূর্ণ অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে যথা-
ক) যেসব অসুস্থ মানুষ রোযা রা’লে রোগ বাড়বে তাদের সাময়িকভাবে রোযা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। পরে তাদের কাযা রোযা করতে হবে।
খ) যেসব ক্রনিক রোগী বর্তমানে রোযা রা’তে পারছে না এবং ভবিষ্যতেও তাদের পক্ষে রোযা রাখা সম্ভব হবে না, এমন রোগীদের রোযা থেকে স্থায়ী অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তারা এক্ষেত্রে একজন গরিব অভুক্ত রোযাদারকে পুরো রোযার মাস খেতে দিয়ে ক্ষতি পূরণ করবে।
গ) মেয়েদের মাসিক ঋতুর সময় এবং সন্তান জন্মাবার পর নেফাস অবস্থায় রোযা থেকে সাময়িক অব্যাহিত দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মায়েদেরও একই ধরনের অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
রোযা নিয়ে অমুসলিম সমাজে অহেতুক কিছু ভীতি রয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যে রোযা রাখে তার জন্য এটা কোনও কষ্টকর কিছু নয়। প্রথম দু’চারটি রোযা একটু একটু কষ্ট হলেও এরপর শরীর এতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। ফলে শেষের দিকে রোযার আর অসুবিধা হয় না। বিশেষত যদি ছোটবেলায় অভ্যাস করা হয়।
এ বিষয়েও মানুষের ভুল ধারণা আছে। এটা অনেকে মনে করে যে, রোযার মাসে মুসলিম দেশে কাজকর্ম-ব্যবসা-বাণিজ্য সব স্থবির হয়ে যায়। এই ধারণা মোটেই ঠিক নয়। রোযার কারণে ক্লান্তি থেকে মানুষের কাজের গতি একটু হ্রাস পেতে পারে, কিন্তু তা বড় কোনও ব্যত্যয় ঘটায় না। অধিকাংশ দেশে রোযার সময় অফিস-আদালতের সময়সূচি পরিবর্তন করা হয়। সুবিধাজনক সময়সূচিতে রোযাদাররা স্বাভাবিকভাবেই কাজ করেন। ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাঙ্কিংও আগের গতিতেই চলে। সঙ্গত কারণেই দিনের বেলা রেস্টুরেন্ট ব্যবসা কম হয়। কিন্তু অন্যদিকে ইফতার ও সেহেরীর সময় তারা ব্যবসা করে পুষিয়ে নিতে পারে।
আল্লাহর ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণের এক অনুপম উদাহরণ রোযা। মানুষের জীবনকে আল্লাহর আদেশে পরিচালিত করা উত্তম পন্থা। মানুষ তার মধ্যে সংযম ও আত্মনিয়ন্ত্রণ এনে দেয়। যা তাকে অনৈতিক সকল লোভকে জয় করার সাহস ও শক্তি দেয়। রোযার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর কাছ থেকে নিজের ভুল ও পাপসমূহ (গুনাহসমূহ) ক্ষমা করিয়ে নেওয়ার সুযোগ পায়। এটা অসৎ প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে এক জিহাদ। রাসূল সা. বলেন, ‘যে ব্যক্তি রোযা রেখেও অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকল না, তার না-খেয়ে থাকার প্রতিদান দেওয়ার কোনও প্রয়োজন আল্লাহর নাই।’
রোযা শুধু ব্যক্তিগত ইবাদত নয়। এটা একটি সামাজিক ইবাদত। রোযার ক্ষুধার অভিজ্ঞতা লাভ করে মুসলমানরা গরিব ও দরিদ্র মানুষের কষ্ট বুঝতে পারে। তারা আরও দানশীল হয়। রমযান মাসেই সাধারণত মানুষ যাকাত বিতরণ করে। রমযান শেষে মানুষ খুব সকালে ওঠে। উত্তম পোশাক পরে আল্লাহর প্রশংসা করতে করতে ঈদের জামায়াতে যায়। ঈদের জামায়াতে বিশেষ বক্তব্য (খুত্বা বা বক্তব্য) রাখা হয়। নামাযের পর মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ, মোলাকাত করে। আত্মীয় বান্ধবের বাড়িতে যায়। নিজেদের মধ্যে উপহার ও শুভেচ্ছা বিনিময় করে।