বিশেষ প্রতিবেদক: অসম সীমান্তবর্তী মেঘালয়ে অবস্থিত ইউনির্ভাসিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির চ্যান্সেলার মাহবুবুল হককে হিমন্ত সরকারের পুলিশ ও অসম এসটিএফ হঠাৎই শুক্রবার গভীর রাতে গ্রেফতার করেছে। তাঁর মতো একজন শিক্ষাবিদ ও সম্মানিত ব্যক্তিত্বকে এভাবে গ্রেফতার করায় সারা অসমে ক্ষোভ ও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। মাহবুবুল হক উত্তর-পূর্ব ভারতে শিক্ষা বিস্তারে এক বড় ভূমিকা রাখছিলেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ইউনির্ভাসিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (ইউএসটিএম) মেঘালয়, অসম এবং উত্তর ভারতে অন্যান্য স্থানে বিজ্ঞান-সহ অন্যান্য বিষয়ে শিক্ষার আলোর বিস্তার করছিল। মেঘালয়ের এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০,০০০-এরও বেশি পড়ুয়া রয়েছে। আর তাদের শিক্ষাদানের জন্য রয়েছে সারা ভারত থেকে সংগৃহীত উঁচুমানের শিক্ষক ও অধ্যাপকবৃন্দ। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন একটি মেডিক্যাল কলেজের সম্প্রতি উদ্বোধন হয়েছে এবং প্রথম থেকেই তার পরিকাঠামো এবং শিক্ষার মান সকলের সৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
মেঘালয়ের উচ্চপদস্থ অফিসার, মন্ত্রী এবং অন্যান্যদের মতে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি এই রাজ্যের গর্ব। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা চ্যান্সেলার শিক্ষাবিদ মাহবুবুল হককে হঠাৎ কেন গ্রেফতার করা হল, বাহ্যত তার কোনও কারণ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কিন্তু মুসলিম বিদ্বেষ ও নৃশংস অত্যাচারে যোগীকে ছাড়িয়ে যাওয়া হিমন্ত বিশ্ব শর্মার জন্য কোনও কারণ প্রয়োজন নেই। তিনি ভারতে সাংবিধানিক পদে থেকেও ভারতে মুসলিম বিদ্বেষী মুখ্যমন্ত্রীর নমুনা হয়ে উঠেছেন। আইন, সংবিধান বা সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের কোনও ধার হিমন্ত বিশ্ব শর্মা ধারেন না। মুসলিমদের বিরুদ্ধে তিনি নতুন বহু ঘৃণাসূচক বৃতান্ত তৈরি করেছেন। যেমন, মুসলিম কৃষকদের জন্যই বাজারে সবজি ও শস্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। মুসলিমদের জন্যই বরাক উপত্যাকায় বন্যা হচ্ছে। অসমের নামিদামি-সহ সব মাদ্রাসা তিনি বন্ধ করে দিয়েছেন। এনকাউন্টারে মুসলিম ও আদিবাসী যুবকদের মারা হচ্ছে। মুসলিম গ্রামগুলি অবৈধ বলে ঘোষণা করে হাতি ও বুলডোজার দিয়ে তা ধ্বংস করা হচ্ছে ইত্যাদি অনেক কিছুই তাঁর মুসলিম-ঘৃণার খাতায় রয়েছে।
হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বরাক উপত্যাকার একজন মুসলিম মাহবুবুল হকের উত্থানকে সহ্য করতে পারেননি। তিনি গতবছর দুয়ের ধরে তাঁর বিরুদ্ধে নানা আজব ও কাল্পনিক অভিযোগ করা শুরু করেন। অনেকে বলছেন, হিমন্ত বিশ্ব শর্মা মেঘালয়ে একটি মেডিক্যাল কলেজ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মাহবুবুল হক তার আগে সমস্ত আইন ও শর্ত মেনে মেডিক্যাল কলেজ খুলে ফেলায় তিনি ভীষণ ক্রুদ্ধ হন। হিমন্ত ইতিমধ্যে অসমে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলেছেন। তাঁর স্ত্রীর নামে স্কুল, কলেজ ও শিক্ষা-সিটির মালিকানা রয়েছে। অসমে হিমন্ত বিশ্ব শর্মা নানা ধরনের ব্যবসা ও শিল্পের সঙ্গে জড়িত। তাঁর রয়েছে মিডিয়ায় সাম্রাজ্য। অবশ্য মালিকানা হিমন্তের স্ত্রীর নামে। হিমন্ত জানেন, তাঁর বিরুদ্ধে ইডি বা ইনকাম ট্যাক্স বিভাগ কখনোই সক্রিয় হবে না। তিনি মোদির লোক।
গুয়াহাটিতে অবস্থিত মাহবুবুল হকের বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে তাঁকে এখন করিমগঞ্জে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে, সেখানকার একটি স্কুলের ছাত্ররা ব্যাপক ভাঙচুর করেছে। এই স্কুলটি মাহবুবুল হকের ট্রাস্ট ইআরডি ফাউন্ডেশনের পরিচালনাধীন। কেন ভাঙচুর? অভিযোগ হচ্ছে, এই স্কুলটি নাকি ছাত্রদের মিথ্যা বলে নিয়ে এসেছিলেন। স্কুলটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষায় তাদের ৩০ নম্বরের জন্য ‘সহায়তা’ দেওয়া হবে। এই ‘সহায়তা’ না পেয়েই ছাত্ররা নাকি ভাঙচুর চালায়।
এসব অভিযোগের কোনও প্রমাণ নেই। যদি কেউ অবৈধ প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে, তবে গ্রেফতার করা উচিত সেই ব্যক্তিদের। আর গ্রেফতার হওয়া উচিত ওই ছাত্র যারা অবৈধ ‘সহায়তার’ আশায় ওই স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। তা না করে, একটি ন্যাক-এ প্রাপ্ত এবং উচ্চমানসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপরিচিত চ্যান্সেলরকে গ্রেফতার করে কারাগারে ঢোকাতে হবে, এই যুক্তি মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। এ ছাড়া স্থানীয় লোকেরা বলছেন, যারা ভাঙচুর করেছে তারা ওই স্কুলের ছাত্রই নয়। এদের বাইরে থেকে আনা হয়েছিল। হিমন্ত অবশ্য আরও অনেক অভিযোগ করেছেন মাহবুবুল হকের বিরুদ্ধে। একটি অভিযোগ হচ্ছে, অসম সীমান্তবর্তী মেঘালয়ের এলাকায় তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপন করায় নাকি গুয়াহাটিতে বন্যা হচ্ছে। হিমন্তের বক্তব্য, মাহবুবুল হকের ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য পাহাড় ও জঙ্গল কাটা হয়েছে। আর সেজন্যই গুয়াহাটিতে মাঝেমধ্যে জলবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ সবই হিমন্তর মুসলিম বিদ্বেষী কল্পনা। মেঘালয়ের ওই এলাকা থেকে বৃষ্টির পানি কখনোই গুয়াহাটির দিকে যায় না। আর সেটা বন্যা সৃষ্টি করার মতোও নয়। মেঘালয় সরকারের অফিসাররা বলেছেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়টি ইউজিসি স্বীকৃতি প্রাপ্ত এবং তারা কোনও ফেক ডিগ্রি বিক্রি করে না। এর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হচ্ছে তা সত্য নয়। কিন্তু কে শুনবে এসব কথা! মুসলিমদের যারাই উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত, তারাই হিমন্তের চক্ষুশূল। তিনি তাদেরকে তাঁর স্বার্থের জন্য বিপজ্জনক বলে মনে করেন। হিমন্ত মেঘালয়ের এই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে ধ্বংস করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন। আর সেই লক্ষ্যে কাজও তিনি শুরু করেছেন। ভুয়ো অভিযোগে মাহবুবুল হকের গ্রেফতারি তারও প্রমাণ।
না, ভারতের সংবিধান রচয়িতারা কখনোই এরকম ভাবেননি। দেশের প্রায় ২৫ কোটি মুসলিমকে হতমান, অপমানিত ও অধিকার বঞ্চিত করে রাখা হবে, তা স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় কেউ বুঝতে পারেনি। গত ১২-১৩ বছর ধরে কেন্দ্রে এবং বেশকিছু রাজ্যে সংঘ পরিবারের রাজনৈতিক শাখা বিজেপি ক্ষমতায় সমাসীন। তাদের দেশ গড়া, দেশের উন্নয়ন, সব মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করার চেয়ে শাসকরা মূলত মুসলিম ও খানিকটা খ্রিস্টান সম্প্রদায়কে ভয়াবহভাবে টার্গেট করেছে। তার বহু নজির মিডিয়াতে প্রকাশিত হয়েছে। এইসব অত্যাচার ও অধিকার হরণ হচ্ছে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ভয়ংকর উল্লঙ্ঘন।
ভারতের মুসলিমরা পিছিয়ে রয়েছে, এ কথা বিভিন্ন সার্ভে ও কমিটির রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু তারা নিজস্ব চেষ্টায় যা কিছু অর্জন করেছিল, তা হরণ করার জন্য শক্তিশালী মহলটি উঠেপড়ে লেগেছে।